শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
এইবার বাঙালীর মিষ্টান্নের কথা বলি।
সাধু ভাষায় মিষ্টান্ন চলিত ভাষায় মেঠাই শব্দ দুটি সম্পূর্ণ সমার্থক শব্দ। দুটিই সমাজ শব্দ। প্রথম শব্দ মিষ্ট, দ্বিতীয় শব্দ যথাক্রমে অন্ন অর্থাৎ খাদ্য এবং খাদিক। মিঠাই শব্দটি খাঁটি বাংলা নয়। শব্দটি এসেছে বৃন্দাবন থেকে ব্রজবুলির মধ্য দিয়ে। ‘অন্ন’ শব্দের বাংলায় একমাত্র শব্দ ‘আনাজ’ আছে। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘অন্নাদ্য’ (মানে ভালো খাবার) থেকে। মিষ্ট শব্দটি সংস্কৃতে পাওয়া গেলেও এটিকে আমার বিবেচনায় প্রাকৃত প্রভাবিত শব্দ বলতে হয়। শব্দটি এসেছে সাংস্কৃত মৃষ্ট থেকে। মৃষ্ট মানে দোয়া দুধ, ইংরেজি milk শব্দের সগোত্র। আমার এই ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয় তবে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কাছে দুধ ও দুধের তৈরি বস্তুই—যেমন ঘি দুই, ক্ষীর— বিশেষ লোভনীয় খাবার (Sweetmeat) ছিল। পরে এত মধু-গুড়-চিনির স্বাদের অর্থ এসে গেছে মিষ্ট শব্দে। মধুর রসযুক্ত এবং লোভনীয় খাদ্যবস্তু দুটি অর্থেই মিষ্ট শব্দটি আমরা ব্যবহার করি।
অন্ন শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে ‘অদ্’ ধাতু থেকে। মানে খাওয়া। খাদিক শব্দ এসেছে ‘খাদ্’ ধাতু থেকে। মানে ছিল চিবিয়ে বা কামড়ে খাওয়া। পরে এই ধাতুর অর্থ বিস্তারিত হয়ে ‘অদ্’ ধাতুকে কথ্য-সংস্কৃত ভাষা থেকে অপসৃত করে দেয়।
মেঠাই শব্দটির এখন দুটি মানে চলে। এক মানে মিষ্টান্ন, অপর মানে একরকম বিশেষ মিষ্টান্ন,—যার নামান্তর মোতিচুর এবং রূপান্তর দরবেশ। অর্থাৎ বোঁদের নাড়ু শক্ত ও নরম। এইখানে দরবেশ নামটির রহস্যভেদ করি। এ নামটি কলকাতায় উৎপন্ন এবং এখনও কলকাতাতেই চলে। দু-তিন রঙের বোঁদের নরম নাড়ু। দরবেশরা যেমন বিচিত্র রঙের কাপড়ের টুকরো সেলাই করে তাদের আলখাল্লা তৈরি করে তেমনি দেখতে বলে। সাদা বোঁদের শক্ত নাড়ুকে বলে মোতিচুর (সংস্কৃত মৌক্তিক+চুট, মুক্তোর টুকরো)।
(ক্রমশ)