• facebook
  • twitter
Monday, 28 April, 2025

বাঙালির ভাষা

আজ থেকে হাজার বছর আগে বাঙালীর প্রধান আহারের উপকরণ ছিল ভাত, ডাল (সাধারণত মাষ কলাইয়ের) ও দই। দইয়ের কদর ডালের চেয়েও বেশি ছিল।

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ঘ্যাঁট ও ঘণ্টের মধ্যে যে তফাৎ সেইরকম তফাৎ ‘চচ্চড়ি’ আর ‘সড়সড়ি’র (ধ্বন্যাত্মক) মধ্যে। দুটিই শুকনো তরকারি। চচ্চড়িতে একাধিক আনাজ থাকে, সড়সড়িতে একটি মাত্র, তাও শাক।

এক আনাজ, নরম করে ভাজা, অল্প মিষ্টি দেওয়া— নাম ছেঁচকি। আনাজ মানে তরকারির কাঁচা মাল, সবজি। শব্দটি এসেছে বৈদিক সংস্কৃত ‘অন্নাদ্য’ থেকে। মানে খাবার যোগ্য (’আদ্য’)। দুটি শব্দই খাওয়া অর্থে প্রাচীন ধাতু অদ্ থেকে উৎপন্ন। বাংলা ‘খাওয়া’ এসেছে ‘সংস্কৃত ‘খাদ’, ধাতু তেকে। মানে ছিল ‘কামড়ে খাওয়া’। এ মানে রয়ে গেছে ‘খাজা’ (শক্ত মিষ্টান্ন) শব্দে।

‘বড়াবড়ি’ আগে বলেছি। তবে বড়ার সম্বন্ধে আরও একটু বলবার আছে। বড়া দু’রকমে তৈরি হত। এক তাওয়াতে সামান তেল বুলিয়ে সেঁকে নিয়ে। নইলে তেলে ছেঁকে। লুচির মতো ছাঁকা বড়াকে বলত ‘তোলো বড়া’ (ষোড়শ শতাব্দ)। শব্দটির উৎপত্তি দুভাবে হতে পারে। এক ‘তেলো’ (অর্থাৎ তেল ছাঁকা) নয় তুলো (অর্থাৎ নরম)। প্রথম ব্যুৎপত্তিই ঠিক বলে মনে হয়।

বাঙালীর স্বাদ সবরকম। টক, ঝাল, মিষ্টি ও তেতো— সবরকম তরকারিতে তার টান। এখানকার দিনে তেতো তরকারিকে বলে সুক্তো। ঝোলও হতে পারে, ঘ্যাঁটও হতে পারে চচ্চড়িও হতে পারে। সুক্তোর প্রসঙ্গে একটু ঐতিহাসিক আলোচনার সুযোগ নিই। কবিকঙ্কন মুকুন্দ সিংহল যাত্রী বাঙাল নাবিকদের দুর্দশার প্রসঙ্গে তাঁদের দিয়ে বলিয়েছেন ‘হুক্তা খাবার হোলনা গেল’। এই উক্তি থেকে অনুমান করতে হয় যে সমুদ্রে দীর্ঘকালের যাত্রীরা শুকনো শাকপাত নিয়ে যেতেন আর তা সেদ্ধ করে তার ঝোল পান করতেন। এখনো সুক্তোর ঝোলই বেশি চলে যদিও সুক্তো মানে এখন সর্বদা শুকনো পলতা বা নিমপাতা নয়।

সাধারণত পলতা পাতা অথবা নিমপাতা কিংবা উচ্ছে-করলা দিয়ে সুক্তো রান্না হয়। শব্দটি এসেছে ‘শুষ্ক-পত্র’ থেকে। মনে হয় একদা শুকনো পলতা (মানে, পটোল গাছের পাতা) অথবা নিমপাতা এই কাজের জন্যে শুকিয়ে রাখা হত। কবিকঙ্কণের লেখা থেকে জানতে পারি যে দীর্ঘকালের নৌযাত্রীরা ‘সূকুতা’ সঙ্গে রাখতেন তরকারি করবার জন্য। নিশ্চয়ই নানারকম শাকসবজি ‘সূকুতা’ করা হত।

আজ থেকে হাজার বছর আগে বাঙালীর প্রধান আহারের উপকরণ ছিল ভাত, ডাল (সাধারণত মাষ কলাইয়ের) ও দই। দইয়ের কদর ডালের চেয়েও বেশি ছিল। একদা বৃন্দাবনের মতো বিদেশে তীর্থযাত্রী বাঙালী এলে ‘দধিভাত তৈল মর্দন’ পেলেই খুশি হত। একথা কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলে গেছেন। তাঁরও দু-তিনশ বছর আগে এক বাঙালী কবি পাড়াগাঁয়ে থাকবার সুখ বর্ণনা করেছেন এই বলে যে কচি সর্ষেশাক ও হড়হড়ে দই দিয়ে ভাত খেয়ে পাড়া গাঁয়ের লোক সুখে থাকে।
বাঙালীর প্রাত্যহিক অন্নাহারের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিবরণ দিলুম না পিষ্টপেষণের বাহুল্য বর্জন করবার জন্যে। পাঠককে অনুরোধ করি আমিষ ভোজ্য তালিকার জন্য মুকুন্দের অভয়ামঙ্গল ও নিরামিষ ভোজ্যের জন্য কৃষ্ণদাসের চৈতন্যচরিতামৃত দেখতে।

(ক্রমশ)