শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
যে সমাজে পুত্রের অধিকার ছিল এখনকার মেয়েদের মতো। বাপ যা দেয় শুধু তাই পায় সে। শব্দটির উৎপত্তি কোন্ অঞ্চলে হয়েছিল তা বলা যায় না।
দুহিতার স্বামী ‘জামাই’, সংস্কৃত জামাতৃক (জামাত্) থেকে। বোনের স্বামী ‘বোনাই’ (ভগিনীপতি), অধুনা ‘ভগ্নিপোত’।
এইবার সংসারের রসদের কথা বলি।
বাঙালীর প্রধান খাদ্য ভাত। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভক্ত’ থেকে, মানে ভাগ। ফিউড্যাল আমলে, সংসারের কর্তা, ভগবান মানে মালিক সকলকে খাদ্য অথবা রসদ যথাযোগ্য বাঁটোয়ারা করে দিতেন। সেই ব্যক্তির প্রাপ্য অংশই হল তার ‘ভক্ত’। ভাতই ছিল এই ভাগ করে দেওয়া রসদের সার। তাই ‘ভক্ত’ শব্দের একটি মানে দাঁড়িয়েছিল সিদ্ধ চাল খাদ্য। (আর একটি অর্থ রয়ে গেছে ভগবান বিষ্ণুর প্রসাদ অন্নের ভাগীদার, তার অনুচর অর্থাৎ ভক্ত।) ধান শুকিয়ে অথবা সিদ্ধ করে ও শুকিয়ে তারপর তুষ ছাড়িয়ে চাল হয়। চাল সিদ্ধ করলে হয় ভাত। প্রাচীনতর রূপ চাউল। শব্দটি এসেছে বোধহয় সংস্কৃত *চাপল থেকে। মানে যা চিবানো যায়, চানা চাবানা। তার থেকে শক্ত খোসা ছাড়ানো বীজ। তুলনীয় ‘ধানের চাল’। ধান থেকে শুধু ভাতই নয় বাঙালীর প্রধান অপর খাদ্য চিড়া (সংস্কৃত চিপিটক, মানে চ্যাপটা সিদ্ধ চাল), খই (সংস্কৃত খদি, ভাজা ধান, মুড়ি (মুড়মুড়ে খাদ্য, ভাজা চাল), হুড়ুন (মুড়ির মতো, তবে চিঁড়ার চেয়েও হালকা), মুড়কি (গুড়ে বা চিনিতে পাক করা খই) ইত্যাদি হয়।
অন্যান্য বীজ ফসলের (grain) মধ্যে ছিল— যব, তিল, সরষে, মাষকলাই, মুগ, মুসুরি, ছোলা ও বরবটি। অড়র পরে এসেছে, তারও পরে মটর। যব খাওয়া হত ‘ছাতু’ (সংস্কৃত শক্তুক) করে। ছাতু গুলে খেলে বলত ‘জাউ’ (মধ্য বাংলা), সংস্কৃত যবাগু থেকে। যবের চাষ পরে কমে গিয়েছিল, তবে জাউ কথাটি লুপ্ত হয়নি। ‘খুদের জাউ’ শব্দে তা রয়ে গেছে।
‘গোম’ বা গমের (সংস্কৃত গোধূম) চাষ আগে এদেশে ছিল না। পশ্চিম থেকে এসেছে মুসলমান আমলে। তিল থেকে তেল হত। তরকারি ও মিষ্টিতেও চলত। সর্ষেতে তেল হত, সর্ষে শাকে তরকারি হত। মাষকলাই মুগ ও মুসুরি গোটা সিদ্ধ করে খাওয়া হত, তবে ডালই বেশি হত।
সবজির মধ্যে হত পটোল, বেগুন, কুমড়ো (সংস্কৃত কুষ্মান্ড-ছাঁচি বা চাল কুমড়ো, মিষ্টি কুমড়ো যা কোন কোন অঞ্চলে ডিংলে, মানে বৃহাদাকার—বলা হয়, তা পরে এসেছে), করলা (সংস্কৃত কারবেল্ল), লাউ (সংস্কৃত অলাবু), কচু (সংস্কৃত কচী), মূলো, (সংস্কৃত মূলক), আদা (সংস্কৃত আর্দ্রক), কচু (সংস্কৃত হরিদ্রা) ইত্যাদি শাকও নানারকম উৎপন্ন হত।
(ক্রমশ)