পূর্ব প্রকাশিতর পর
বেড়া দেওয়া বা ঘেরা স্থানে যেমন গোয়ালবাড়ি (গোলাবাড়ি) যে বেড়া দেওয়া বা প্রাচীর দেওয়া স্থানে ধানের গোলা বা মরাই থাকে।
অক্ষবাটক (মানে জুয়া খেলার স্থান) থেকে ‘আখড়া’। জুয়াখেলার (সেই সঙ্গে মল্লক্রীড়ার স্থান গ্রামের বাইরে হত। সেই কারণে বৈষ্ণবের ‘আখড়া’। ‘খেত বাড়ি’ শব্দে (সংস্কৃত ক্ষেত্রবাটিকা থেকে) মূল অর্থ, ভূমি, অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ‘ঘাসিআড়া’, ‘ঘেসেড়া’ (* ঘাসিক+বাটক) শব্দেও বাটক শব্দের মূল অর্থ ধরা পড়ে।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ এক অঞ্চলে (residence) অর্থে ‘বাকুল’ শব্দটি প্রচলিত আছে। যেমন, মনিব এখন কোথায় আছেন, চাকরকে এই প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিলে, ‘বাবু বাকুলে আছেন।’ অর্থাৎ বাবু এখন কাছারি থেকে বাড়িতে চলে গেছেন খাওয়া দাওয়া করতে। এই অর্থে মুকুন্দ ‘বাকুড়ি’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। শব্দটির ব্যুৎপত্তি অনুমান করি সংস্কৃত * ’বাতক্রোড়’ থেকে (মানে, নিবাত নিভৃত স্থান)।
বাড়ির পিছনের অংশে বাগান না থাকলে, পতিত জমি হলে বলে ‘আঁদাড় পাঁদাড়।’ যুগ্ম শব্দটি এসেছে বাংলা আঁদাড় পা-দাঁড় (<সং অ-দন্ড পাদদন্ড থেকে)। মানে চলবার রাস্তা নেই, কোন রকমে পায়ে চলা যায়। ‘আঁদাড়’ মানে যেখানে পায়ে চলে যাবার কোনো রকম রাস্তা নেই। ‘পাঁদাড়’ হল পায়ে চলার রাস্তা আছে যেখানে অর্থাৎ খিড়কী পথ। সাময়িক বাসস্থান (camp) অর্থে সংস্কৃত ‘বাসক’ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে সপ্তম শতাব্দ থেকে। ভস্করবর্মা একটি অনুশাসন দিয়েছিলেন তাঁর কর্ণসুবর্ণ ক্যাম্প থেকে (‘কর্ণসুবর্ণ-বাসকাৎ’)। শব্দটি বাংলায় হয়েছে ‘বাসা’!, ‘বাসাবাড়ি’। আবার স্বতন্ত্রভাবে ‘বাসা’ ও ‘বাড়ি’ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাড়ি—স্থায়ী আবাস, বাসা—অস্থায়ী আবাস। সংস্কৃত সংসার শব্দটি আসল অর্থ, ‘পরপর চলে আসা’। বাংলায় আমরা ব্যবহার করি ঘরকন্না যা পূর্বপুরুষ থেকে চলে এসেছে এবং পরপুরুষেও চলবে, এই অর্থে। অর্থাৎ গার্হস্থ্য ও সামাজিক জীবনের কান্ডপ্রবাহ। ‘ঘরদুয়ার’-এর উপর হল ‘ঘর-সংসার’। ইংরেজী family শব্দের অর্থে এখন পরিবার শব্দটি চলছে। শব্দটি সংস্কৃত। আসল মানে, যা বা যারা ঘিরে থাকে। মধ্য বাংলায় সাধারণত কর্তা ছাড়া ঘরের ছেলে-মেয়ে বউ-ঝি, দাস-দাসী এদের বোঝাত। এখন বাংলায় দুটি অর্থে চলে। প্রথম অর্থ, কর্তা গিন্নিকে ঘিরে সংসারের ইউনিট (unit)। দ্বিতীয় অর্থ, ঘরের কর্তার (অথবা কোন ব্যক্তির) গিন্নী। ঘর থেকে ঘরের লোকের কথায় আসি। ঘরের প্রধান কর্তা-গিন্নি হলেন স্বামী-স্ত্রী। দুটি শব্দই তৎসম (অর্থাৎ সংস্কৃত)। স্বামী মানে মালিক। স্ত্রী শব্দের মানে নারী, এখানে ঘরের প্রধান নারী। শব্দটির অর্থ পিছন ফিরে অনুসন্ধান করলে আমরা জানতে পারি যে শব্দটির গোড়ায় অর্থ ছিল একদিকে গাই গোরু, অপরদিকে তারা, নক্ষত্র।
(ক্রমশ)