শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
দেওয়াল-বেষ্টিত অথবা তা নয় অথচ একাধিক ব্যক্তি যেখানে কর্মরত এমন ঘর বোঝাতে ‘শাল, শালা’ (সংস্কৃত শালা) পদের (?শব্দের) দ্বিতীয় অংশ রূপে পাওয়া যায়। কামারশাল; ঢেক্শাল (অর্থাৎ ঢেঁকিশালা; বিকৃত রূপ ঢেঁসকাল); তাঁতশাল; নাটশাল (মধ্য বংলা, যেখানে নাট অর্থাৎ নাচ-গান ইত্যাদি হয়); পাঠশাল (পাঠশালা); রসুইশাল অর্থাৎ রান্নাঘর, রসুইঘর)। পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চলে শুধু ‘শাল’ শব্দটি ব্যবহার হয় আখ মাড়াই ও গুড় ভিয়ানের স্থান ও আয়োজন বোঝাতে। শব্দটি * আখশালের খণ্ড রূপ।
ঘরের দীন সংস্করণ হল ‘কুড়িআ’ (প্রাচীন বাংলা), কুঁড়ে (কুঁড়ে ঘর)। সংস্কৃত মূল ‘কুটী’ (তুলনীয় ‘কুটীর’)। কুঁড়েরই দীনতম সংস্করণ হল ‘ঝুপড়ি’ (গাছপালা দিয়ে তৈরি, ঝোপের মতো।) পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল বিশেষে এই রকম অর্থে আর একটা শব্দ চলিত আছে, —‘ঘুপি’ (?)
সদর, কাছারি, বৈঠকখানা বোঝাতে সংস্কৃত ‘উপকারিকা’ শব্দের প্রয়োগ আছে সেনরাজাদের অনুশাসনে। শব্দটির মৌলিক মানে হচ্ছে, সুসজ্জিত আবাস, কাজের ঘর। মধ্য বাংলায় শব্দটি হয়েছে ‘উয়ারি’ মানে সদর মহল। এবং এই শব্দেরই জুড়ি পাই ‘মেহেরি’ (প্রাচীন বাংলা, সম্ভবত * মহিলাআগারিক থেকে), মানে অন্দর মহল। কাছারি (মধ্য বাংলা ‘কচহরি’) এসেছে * কৃত্য ঘরিক অথবা * কৃত্য-অগরিক থেগেক, মানে কাজের ঘর। ‘বৈঠকখানা’ হচ্ছে মিশ্রভাব বাক্যাংশ (‘‘বইঠ + ক + খানা’’ অর্থাৎ, বসে আড্ডা দেবার স্থান)। প্রথম অংশ তদভব হিন্দী, দ্বিতীয় অংশ ফারসী।
‘অন্তউড়ি’ (প্রাচীন বাংলা), ‘আঁতুড়’ (ঘর) এসেছে সংস্কৃত অন্তঃ কুটী থেকে। মৌলিক অর্থ, অন্দরমহলের কুঁড়ে ঘর।
উপকারিকার একটি খেইয়ে আবার ফিরে যাই। আধুনিক ‘বারোয়ারি’ শব্দটি এসেছে ‘বাহির-উপকারিকা’ অথবা * দ্বার-উপকারিকা’ থেকে। মূল অর্থ ছিল, বাড়ির বাইরে বৈঠকখানা, সুতরাং পাঁচজনের অধিকারে।
কোঠা বাড়ি অর্থে ‘ইমারৎ’ ও ‘দালান’ শব্দ এসেছে যথাক্রমে আরবী ও ফারসী ঘরগুলির সামনে যে লম্বা ও প্রশস্ত corridor, তাকে বলে ‘দরদালান’। এও ফারসী শব্দ। মানে লম্বা, কোল ঘর।
আমাদের দেশের ইতিহাসের ইঙ্গিত যে সময় থেকে প্রথম পাওয়া যাচ্ছে তখন দেশে বসতি ভূমির অভাব ছিল না। নদী নালায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ছিল অথবা বনে-জঙ্গলে অগম্য অভেদ্য ছিল। এবং বসতি করবার লোকেরও প্রাচুর্য ছিল বলে মনে হয় না। সুতরাং যাঁরা এসে উপনিবিষ্ট হতেন তাঁরা সাধারণত ভূমিরও মালিক হতেন। তাই সে স্থান ছেড়ে উঠে যাবার কোন প্রবৃত্তিই হত না, উপরন্তু আসক্তি হত ভূমিখণ্ডটুকুর উপর।
(ক্রমশ)