পূর্ব প্রকাশিতর পর
বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ ঐক্যের প্রধান অন্তরায় মনে করিয়া, কেহ-কেহ হয়তো এগুলির সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন ও ইহাদের স্থানে একমাত্র হিন্দীর অবস্থান কামনা করিবেন; কিন্তু কার্য্যতঃ তাহার সাধন করা অসম্ভব— এক কোটি, দুই কোটি, পাঁচ কোটি, লোকের ভাষাকে এভাবে মারা যায় না। বিশেষতঃ প্রান্তিক জনগণ যেখানে পৃথক্ প্রান্তিক সত্তা সম্বন্ধে সাত্মাভিমান হইয়া উঠিয়াছে, সেখানে এরূপ কল্পনা করাও যায় না।
এই প্রান্তিক সত্তার প্রাণ-ই হইতেছে—প্রান্তিক ভাষা. এইজন্য বিভিন্ন প্রান্তিক ভাষা যাহারা বলে, তাহাদের স্বতন্ত্র সত্তা মানিয়া লইয়া, সম্পূর্ণ রূপে একীভূত রাষ্ট্রের পরিবর্তে, রাষ্ট্র-সঙ্ঘের গঠনকেই আদর্শ ধরিতে হয়। সোভিয়েৎ যুক্তরাষ্ট্রে এইরূপ হইয়াছে। রুষ সাম্রাজ্যের তাবৎ ভাষাকে এখন নিজ নিজ গৃহে স্ব স্ব রাষ্ট্রীয় ভাষা বলিয়া সমগ্র দেশ গ্রহণ করিয়াছে। ভারতবর্ষের পক্ষেও দাঁড়াইতেছে তাহা-ই। The United States of India, অর্থাৎ ‘ভারতবর্ষের সংযুক্ত বঙ্গদেশ’— ইহা হইতেছে ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শ। কংগ্রেস ভারতকে বঙ্গদেশ, আসাম, উৎকল, বিহার, হিন্দুস্থান বা সংযুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হিন্দুস্থানী মধ্য-্রদেশ, মহাকোশল, মারাঠী মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, সিন্ধু, গুজরাট, অন্ধ্র, তামিল-নাড়ু, কেরল, কর্ণাট প্রভৃতি ভাষাগত প্রদেশে বিভাগ করিয়াছে। এক-একটি প্রদেশে এক-একটি ভাষা, এক-একটি ভাষা অবলম্বন করিয়া এ-একটি স্বতন্ত্র জাতি; সকলেই বৃহত্তর বৃত্ত-স্বরূপ ভারতবর্ষের অন্তর্গত, সকলেরই প্রাদেশিক বা প্রান্তিক সত্তা বা সভ্যতা প্রাচীন ভারতের সার্বভৌম বারতীয় সত্তা বা সভ্যতার উপরে প্রতিষ্ঠিত, সকলেই হিন্দী ভাষাকে ‘রাষ্ট্র ভাষা’ বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে, ব্যবহার করিতে হইবে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও, প্রত্যেকেরই কিছু-না-কিছু বৈশিষ্ট্য আসিয়া গিয়াছে; সকলেরই অবশ্যম্ভাবী, অপরিহার্য্য ও অনপনেয় সম্মিলনে আধুনিক কালের এক অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠা।
বাঙ্গালী জাতির বা বাঙ্গালা দেশের সম্বন্ধে কিছু কথা বলিতে হইলে, ভারতবর্ষকে বাদ দেওয়া চলে না। ভারত হইতেছে সাধারণ, বাঙ্গালা হইতেছে বিশেষ। যাহা লইয়া বাঙ্গালীর বাঙ্গালীত্ব, বাঙ্গালীর অস্তিত্ব, তাহার মধে বেশীর ভাগ-ই ভারতবর্ষের অন্য জাতির মধ্যেও মিলে; ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের সঙ্গে সেই-সব বিষয়ে বাঙ্গালীদের সমতা আছে। বিশেষের উপরে ঝোঁক দিয়া সাধারণকে ভুলিলে চলিবে না— সাধারণটাই যখন প্রধান। ভারতের সমস্ত-প্রদেশ-সুলভ একটা সাধারণ ভারতীয়ত্ব আছে, বাঙ্গালাও তাহার অংশীদার। অন্য দেশের সমক্ষে, ভারতের সমস্ত প্রদেশে বিদ্যমান এই ভারতীয়ত্বটুকু, ঈষৎ-পরিবর্তিত বিভিন্ন প্রাদেশিক রূপে তত্তং প্রদেশের বৈশিষ্ট্যের পর্য্যয়েই পড়ে। একটি বাহ্য ও সহজ ব্যাপারেই এইটি দেখা যায়।
আমাদের চেহারায় একটি সাধারণ অনন্যদেশ-লভ্য ভারতীয়ত্ব বা ভারতীয় বৈশিষ্ট্য আছে; অন্য দেশের মানুষের তুলনায়, আমাদের দেশের যে-কোনও প্রদেশের মানুষের মধ্যে এই জিনিসটি পাওয়া যায়। গায়ের গৌর-বর্ণে, কিংবা শ্যাম-বর্ণে, মুখ-চোখের সমাবেশে, চাহনিতে, চলনে, বলনে, এমন একটা লক্ষ্যণীয় জিনিস আছে, যাহা কেবল ভারতবর্ষেরই পরিচায়ক। অত্যন্ত গৌরবর্ণ পারসী অথবা কাশ্মীরী, অত্যন্ত দীর্ঘাকৃতি পাঞ্জাবী, খুব খাটো চেহারার এবং খুব কালো রঙ্গের সাঁওতাল, প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় জনসঙ্ঘের মধ্যে কতকগুলি extreme type অর্থাৎ চূড়ান্ত প্রতীক বাদ দিলে, যে-কোনও প্রদেশ হইতে হউক না কেন, সাধারণ ভারতবাসী জনকতককে ধরিয়া, তাহাদের দেহ হইতে কানের মাকড়ি, লম্বাচুল, গালপাট্টা, উড়ে খোঁপা, লম্বা টিকি, ফোঁটা বা বিভূতির ঘটা, মুসলমানি কায়দায় ছাঁটা গোঁফ, প্রভৃতি প্রাদেশিক বা সাম্প্রদায়িক লাঞ্ছনা দূর করিয়া দিয়া, এক রকমের কাপড়-চোপড় পরাইয়া দিলে, তাহারা কোন্ প্রদেশের লোক তাহা বলা কঠিন হইবে। ইউরোপে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে এ-জিনিস দেখিয়াছি, আমার মতো অনেকেও দেখিয়াছেন; এদেশেও লোকে অহরহঃ দেখিতেছে। ইংরেজি পোশাক-পরা সাধারণ ভারতীয় মানুষকে, যদি বাঙ্গালায় বা বাঙ্গালার বাহিরে রেলে বা অন্যত্র দেখি, তাহা হইলে জোর করিয়া বলা কঠিন হয়— লোকটি কোন্ প্রদেশের; লোকটি বাঙ্গালী হইতে পারে, না-ও হইতে পারে, এ বোধও আমাদের আসে। আকারে যেমন, প্রকৃতিতেও তেমনি—বাঙ্গালী ভারতীয়-ই বটে।
(ক্রমশ)