পূর্ব প্রকাশিতর পর
এইভাবে বাঙ্গালার পণ্ডিতের হাতে দুই দিকে কাজ চলিল; বাঙ্গালার সংস্কৃতির দুইটি দিক্-ই ইঁহারা পুষ্ট করিতে লাগিলেন সংস্কৃত বিদ্যা, যাহাকে আশ্রয় করিয়া বাঙ্গালার মস্তিষ্ক খেলিতে লাগিল; এবং বাঙ্গালা কাব্য ও কবিতা, যাহাতে বাঙ্গালার হৃদয়ের প্রকাশ হইল। এই দুই দিকেই, সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব-ই ছিল মূল প্রেরণা। বাঙ্গালার গ্রাম্য জীবনে যে ডাক ও খনার বচন ছিল, তাহা প্রাচীন মুসলমান-পূর্ব যুগের সংস্কৃতির প্রতিধ্বনি মাত্র। তুর্কী-বিজয়ের দেড়-শত বৎসরের মধ্যে যখন সমস্ত উত্তর-ভারতময় মুসলমান ভাব-জগতের প্রতাপ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারতের জীবনে অনুভূত হইতে লাগিল, তখন সহজ-বোধ্য ভক্তি-মার্গ পুনরায় প্রকটিত হইল, ‘নাম-ধর্ম’ প্রসার-লাভ করিল। নাম-ধর্মের নানা সাধক দেখা দিলেন; রামানন্দ কবীর প্রমুখ উত্তর-ভারতের সন্তমার্গী সাধুগণ; বাঙ্গালার শ্রীচৈতন্যদেব; এবং পাঞ্জাবে গুরু নানক ও তৎশিষ্য ও অনুশিষ্য শিখ গুরুগণ।
বাঙ্গালীর সংস্কৃতির অনেকটা মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবকেই আশ্রয় করিয়া পুষ্টি-লাভ করে। শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষা ও জীবনী বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে অনেকগুলি নূতন ধারা সৃষ্টি বা প্রবর্তিত করিয়াছিল। সংস্কৃত বিদ্যার মর্য্যাদা তাঁহার হাতে ক্ষুণ্ণ হয় নাই; বৃন্দাবনের গোস্বামিগণ, এবং শ্রীচৈতন্যদেবকে আশ্রয় করিয়া সৃষ্টি গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের গুরু-পরম্পরা, সংস্কৃত ভাষায় যে-দার্শনিক বিচার প্রকট করিলেন, যে-রসশাস্ত্র প্রণয়ন করিলেন, যে সকল মূল গ্রন্থ, টীকা ও কাব্যাদি রচনা করিলেন, তাহা বিদ্যা ও বুদ্ধির দিক্ হইতে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অপূর্ব সৃষ্টি; বাঙ্গালীর বুদ্ধির প্রকাশ যেমন নব্যন্যায়ের ও স্মৃতি-শাস্ত্রের পণ্ডিতগণের এবং শ্রীকুল্লুকভট্ট, শ্রীমধুসূদন সরস্বতী, আগমবাগীশ শ্রীকৃষ্ণানন্দ প্রমুখ টীকাকার ও সংকলয়িতাদের মেধায় দেখা যায়, তেমনি ইহা শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন, শ্রীজীব, শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ বৈষ্ণব আচার্য্যদের পাণ্ডিত্যেও দেখা যায়। আবার বৈষ্ণব পদাবলীতে বাঙ্গালীর হৃদয়ের, তাহার রসানুভূতির যে-পরিচয় পাই, তাহা শ্রীচৈতন্যদেবেরই অনুপ্রেরণার ফল। এতদ্ভিন্ন বাঙ্গালার জন-সংগীত কীর্তনগানে যে লক্ষণীয় এবং অতি বিশিষ্ট মূর্তি ধারণ করিল, বাঙ্গালার নিজস্ব সংগীতের প্রাণ-স্বরূপ সেই কীর্তনগানও সাক্ষাৎ শ্রীচৈতন্যদেবের প্রসাদ। ঘরমুখো বাঙ্গালী ঘর ছায়িা নতুন উদ্যমে পুরী গয়া কাশী বৃন্দবেন গেল, জয়পুরে গেল, এবং আরও পশ্চিমে গেলে;— ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এক সত্যকার গৌরবময় বৃহত্তর বঙ্গের প্রতিষ্ঠা করিল। এখানেও শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনের প্রভাব দেখি।
বাঙ্গালার সংস্কৃতি মুখ্যতঃ গ্রাম্য জীবনকেই অবলম্বন করিয়া পুষ্টিলাভ করিয়াছিল। এদিকে বাঙ্গালা-দেশ বোধহয় আদিম অস্ট্রিক জাতি হইতে প্রাপ্ত রিক্থকেই রক্ষা করিয়া আসিয়াছিল। প্রাচীন ভারতে গ্রাম ও নগর উভয়কেই আশ্রয় করিয়া সভ্যতার প্রকাশ ঘটিয়াছিল। গ্রামের বড়ো দান ছিল দার্শনিক চিন্তা ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি, নগরের দান ছিল বাস্তব সভ্যতা, কর্মপ্রাণ সভ্যতা। ইউরোপের সভ্যতা অর্থ Civilisation—যাহা civis বা নগরকেই অবলম্বন করিয়া থাকে, ‘নাগরিকতার ভাব’ ইউরোপের polis বা নগর হইতে politic-এর উৎপত্তি। আরবদের মধ্যেও ‘মদীনা’ বা নগরের জীবন-যাত্রাই ‘তমদ্দুন’ বা সভ্যতা। কিন্তু বাঙ্গালা দেশে কখনও নগরের প্রাধান্য ছিল না। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে শিল্প-সম্ভারপূর্ণ, বিরাট্ মন্দির ও অন্য গৃহে শোভিত, বড়ো-বড়ো নগর প্রাচীন কাল হইতেই গড়িয়া উঠিয়াছিল দেখা যায়; যেমন, প্রাগৈতিহাসিক মোহেন্-জো দড়ো, হরপ্পা; প্রাচীন কালের অহিচ্ছত্র, মথুরা, কাশী, পাটলিপুত্র, তক্ষশীলা, সাকেত, গোনদ’, উজ্জয়িনী, প্রতিষ্ঠান, ধান্যকটক (অমরাবতী; মহাবলিপুর, কাঞ্চীপুর প্রভৃতি, যে-সব নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখিতে পাই; মধ্য যুগের দিল্লী, আগরা, লাহোর, মদুরা, পুনা, মান্ডু প্রভৃতি। উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতে নগরাদির ধ্বংসাবশেষ যে-রূপ পাওয়া গিয়াছে, বাঙ্গালা দেশে সে-রূপ ততটা পাওয়া যায় নাই; কাশী, মদুরা, পুনা, উজ্জয়িনী, লাহোর প্রভৃতির সহিত একসঙ্গে নাম করা যায় এমন নগর বাঙ্গালা দেশে বেশী গড়িয়া উঠে নাই—বাঙ্গালা দেশের নাগরিক জীবন মুখ্যতঃ গ্রামের জীবনেরই একটি বিস্তৃত সংস্করণ ছিল।
(ক্রমশ)