পূর্ব প্রকাশিতর পর
এই প্রকারের ইতিহাস ও পুরাণ-গ্রন্থ ভাষায় অনূদিত হইতে লাগিল। জন-সাধারণে ইহার স্বাদ পাইল। কথকতা—ভারত-পুরাণ পাঠ—সংস্কৃতি-প্রচার বিষয়ে দেশের এক প্রাচীন পদ্ধতি ছিল। বাঙ্গালা দেশের স্থানীয় পুরাণকথা, যেগুলি সংস্কৃতে লিপি-বদ্ধ হয় নাই বলিয়া ভারতের অন্যত্র সম্পূর্ণভাবে গৃহীত হইতে পারে নাই, সেগুলিও নবীন ‘‘মঙ্গল-কাব্য’’ আকারে বহুল প্রচারিত হইতে লাগিল। এই-সব স্থানীয় পুরাণ মধ্যে, বৌদ্ধ পুরাণও বাদ পড়িল না। এইভাবে রামায়ণ মহাভারত ভাগবত শিবায়ন ও অন্য পুরাণের আখ্যায়িকার পাশে, লখিন্দর-বেহুলা কালকেতু-ফুল্লরা ধনপতি-খুল্লনার কথা এবং লাউসেন ও গোপীচাঁদের কথাও বহুল ভাবে পুনঃপ্রচারিত হইল।
প্রাচীন কথা ও লোক-গাথা মঙ্গল-কাব্যের মধ্যে সাহিত্যিক রূপ পাইল। সমাজের জ্ঞান-ভাণ্ডারের সংরক্ষক ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার নূতন করিয়া জ্ঞান-বল সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি হইল। স্বদেশ সংস্কৃত বিদ্যা মৃতপ্রায়; সংস্কৃতজ্ঞ বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা হয় নালান্দার বিহারের মতো অন্যান্য বিহারের ধ্বংসের কালে তুর্কীর ভল্ল ও তরবারির আঘাতে নিহত রইয়াছেন, না হয় পুঁথি-পত্র লইয়া তাঁহারা নেপালে পলাইয়া গিয়া প্রাণ ও বিদ্যা উভয়েরই রক্ষা করিয়াছেন। পশ্চিম-বঙ্গে তুর্কীর আগমনে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা পলায়ন করিয়া পূর্ব-বঙ্গের নদী খাল বিলের দ্বারা সুরক্ষিত জনপদে আত্মরক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহাদের বিদ্যা দেশের কেন্দ্রস্থলে না থাকায় আর কার্য্যকর হইতেছিল না। তখন বাঙ্গালী ব্রাহ্মণবটু বিদেশ হইতে সংস্কৃত জ্ঞানকে আবাহন করিয়া আনিবার জন্য বাহির হইলেন। মিথিলা সে-যুগে তুর্কীর অধীন হয় নাই। হিন্দু রাজা ছিল বলিয়া, তুর্কী-বিজয়ের পরে ধ্বংসের শতকেও মিথিলার সংস্কৃত বিদ্যার কেন্দ্রস্থলগুলি জীবিত ছিল— বাঙ্গালীর ছেলেরা সেখানে বিশেষ করিয়া ন্যায়শাস্ত্র ও স্মৃতি পড়িতেই যাইত।
এই প্রসঙ্গে রঘুনাথ শিরোমণি ও পক্ষধর মিশ্রের কথা আমরা সকলেই জানি। মিথিলায় যে-সব ছেলে পড়িতে যাইত, তাহারা কেহল যে সংস্কৃত শাস্ত্র পড়িত তাহা নহে। মিথিলার দেশভাষা মৈথিলে ঐ প্রদেশের পণ্ডিতেরা সুন্দর সুন্দর গান বাঁধিতেন। কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর (ইঁহার জীবৎকাল আনুমানিক ১৩৫০ হইতে ১৪৫০ খ্রীস্টাব্দ) মৈথিল কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ বাঙ্গালী ছাত্রদের দ্বারায় বাঙ্গালা দেশে আনীত হয়, এবং সেই-সকল পদের অপূর্ব কবিত্বে বাঙ্গালীদের মধ্যে অনেকে মোহিত হইয়া যান— বাঙ্গালা দেশে সেগুলির বহুল প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের অনুকরণও আরম্ভ হয়। বিদ্যাপতির পদের মৈথিল ভাষা বাঙ্গালীর মুখে অবিকৃত থাকিতে পারিল না; এবং বাঙ্গালীর হাতে বিদ্যাপতির পদের ভাষা বিকৃত হইল, আবার বাঙ্গালা ও মৈথিল এই দুই ভাষা মিলিয়া, মৈথিলের নকলে এক অতি মধুর কৃত্রিম সাহিত্যের ভাষার সৃষ্টি করিল, এই ভাষার নাম হইল ‘‘ব্রজবুলি’’। বাঙ্গালা গীতি-সাহিত্যের অনেকখানি অংশ এই ব্রজবুলিকে লইয়া।
(ক্রমশ)