বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

এইরূপে অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও উত্তর-ভারতের মিশ্র আর্য্য—এই তিন জাতির মিলনে বাঙ্গালী জাতির সৃষ্টি হইল। উত্তর-ভারতের গাঙ্গ সভ্যতাই যেন এই নব-সৃষ্ট আর্য্য-ভাষী বাঙ্গালী জাতির জন্ম-নীড় হইল। রক্তে ও ভাষায় আদিম বাঙ্গালী মুখ্যতঃ অনার্য্য ছিল। যেটুকু আর্য্য রক্ত বাঙ্গালী জাতির গটনে আসিয়াছিল, সেটুকু আবার উত্তর-ভারতেই অনার্য্য-মিশ্র হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আর্য্য ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সৃজ্যমান বাঙ্গালী জাতি একটা নূতন মানসিক নীতি বা বিনয়-পরিপাটি, যাহাকে ইংরেজিতে discipline বলে, তাহা পাইল; বাঙ্গালীর অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রকৃতির উপরে আর্য্য মনের ছাপ পড়িল। ইহা তাহার পক্ষে মঙ্গলের কারণই হইল। আর্য্য মনের—ব্রাহ্মণ্যের— এই ছাপটুকু, আদিম অপরিস্ফুট বাঙ্গালীকে একটা চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য দিল।

খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম পাদে যখন চীনা পরিব্রাজাক Hiuen Tsang হিউ-এন্-থসাঙ্ বাঙ্গালা দেশে আসিয়াছিলেন, তাঁহার কথার ভাবে মনে হয় যে, তখন সমস্ত বাঙ্গালা দেশটা আর্য্য-ভাষী হইয়া গিয়াছিল। তারপরে ৭৪০ খ্রীস্টাব্দের দিকে বরেন্দ্র-ভূমিতে পাল-রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হইল, নবসৃষ্ট বাঙ্গালী জাতি নবীন এক গৌরবময় জীবনে প্রবেশ লাভ করিল। প্রথমটায় বঙ্গদেশের পণ্ডিতেরা সমগ্র ভারতবর্ষের সাহিত্যের ভাষা সংস্কৃতেরই চর্চায় তৎপর হইলেন। তাহার পরে তাঁহারা দেশ-বাষার দিকে দৃষ্টি দিলেন। পাল-রাজগণের রাজ্যের প্রতিষ্ঠার দুই শতকের মধ্যেই মাগধী প্রাকৃত এবং বঙ্গদেশ প্রচলিত মাগধী প্রকৃতের অপভ্রংশ হইতে একটু বিশিষ্ট মূর্তি ধারণ করিয়া, বাঙ্গালা ভাষা, একটি স্বতন্ত্র ভাষা হয়িা দাঁড়াইল; এবং খ্রীষ্টীয় দশম শতকের মধ্য-ভাগ হইতে বৌদ্ধ গুরুদের হাতে এই স্বতন্ত্র ভাষায়, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালায়, সাহিত্য-সৃষ্টি— গান-রচনা— হইতে লাগিল।


আমাদের বাঙ্গালী জাতির ও বাঙ্গালা ভাষা এবং সাহিত্যের উৎপত্তির ইতিহাসের কাঠামো বা মূল-কথা এইরূপ বলিয়াই আমার ধারণা। আর্য্যভাষী বাঙ্গালী জাতির গটনের সঙ্গে সঙ্গে যখন বাঙ্গালী সংস্কৃতির সূত্রপাত হয়, তখন কেহ বাঙ্গালীর নিজস্ব অনার্য্য সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করে নাই; তখন যে-ছাঁচে বাঙ্গালীর মন, বাঙ্গালীর সমাজ, বাঙ্গালীর ঐতিহ্য—রীতি-নীতি শিল্প-সাহিত্য সব-ই ঢালা হইয়াছিল, তাহা ছিল উত্তর-ভারতের বা নিখিল ভারতের সর্ব-জয়ী হিন্দু (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন) মন,—ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন সমাজ, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, শিল্প ও সাহিত্য। যে-ছাঁচে সৃজ্যমান বাঙ্গালী জাতিকে ঢালা হইল, মোটের উপর সেই ছাঁচ এখনও বাঙ্গালী সমাজে বিদ্যমান। উপস্থিত কালে, অর্থনৈতিক ও মানসিক নানা বিপর্য্যয় এবং বিপ্লবের আগমনে, আমরা স্বেচ্ছায় ও অনিচ্ছায় আমাদের সমাজকে ভাঙিয়া-চুরিয়া আবার এক নূতন ছাঁচে ঢালিতে যাইতেছি।

পাল-যুগে নূতন সৃষ্ট বাঙ্গালী জাতির মনের সুর, তাহার আর্য্য-ভাষার তারকে অবলম্বন করিয়া, উত্তর-ভারতের মনের সঙ্গে যেভাবে বাঁধা হইয়া গিয়াছে, মোটের উপর সে-সুরটি এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। এই এক-ই সুরে নানান্ ঝংকার শুনা গিয়াছে; কখনও বৌদ্ধ, কখনও ব্রাহ্মণ্য; ব্রাহ্মণ্যের মধ্যে কখনও বৈদিক (বৈদিকের ঝংকার বাঙ্গালা দেশের সুরে চিরকালই অতি ক্ষীণ ভাবে শূনা গিয়াছে, কখনও শৈব, কখনও শাক্ত, কখনও বৈষ্ণব, এবং কখনও মুসলমান সুফী।

(ক্রমশ)