• facebook
  • twitter
Saturday, 9 November, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

গঙ্গার মতো আর্য্য ভাষার নদী বাঙ্গালা দেশেও বহিল, এই নদীর স্রোতে দেশের প্রাচীন অন্যায্য ভাষা ভাসিয়া গেল— আর্য্য ভাষা প্রাকৃত এই বাঙ্গালায় আসিয়া ক্রমে বাঙ্গালা ভাষার রূপ ধারণ করিল; প্রাকৃতের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ধাত্রী-রূপে সংস্কৃতও আসিল।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

সীতা-সাবিত্রীর সত্যকার পোশাক যাহাই থাকুক (তবে প্রাচীন আর্য্য যুগে মেয়েরা যে ‘ঘাঘরা’ পরিত না, এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই), বাঙ্গালার মাটিতে তাঁহারা কোনও এক অজ্ঞাত পুণ্য মুহূর্তে পাদক্ষেপ করা মাত্রই আমরা তাঁহাদের বাঙ্গালী ধরনের সাড়ি পরাইয়া দিয়া আমাদের নিতান্ত আপনার জন করিয়া লইয়াছি, ঘরের মধ্যেই তাঁহাদের পাইয়া আমরা ধন্য হইয়াছি। রায় বাহাদুরের এই চেষ্টার বিশ্লেষণ এখন করিব না; কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত একটি শব্দ দ্বারা এই চেষ্টার বর্ণনা করা যায়— সে শব্দটা হইতেছে ‘আদিখ্যেতা’— অর্থাৎ, বিশেষ এক প্রকার ভাববিলাসের আতিশয্য; এবং এই চেষ্টার মূলে, অন্যান্য মনোভাব ও চিন্তা ব্যতীত এই জিনিসটি দেখিতে পাই— আমাদের বাঙ্গালার জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা বা আধার-ভূমি কী কী বিষয় লইয়া, তৎসম্বন্ধে অবহিত না হইয়া, নূতন ও অনপেক্ষিত কথা (তাহা যুক্তি-সহ হউক বা না হউক) বলিয়া, Sensationalism বা চমকপ্রদতার সৃষ্টি করা। বঙ্গদেশ তুর্কীদের দ্বারা বিজিত না হইলে, বাঙ্গালা ভাষায় সাহিত্যই গড়িয়া উঠিত না— ইহাও এই রূপই sensational এবং যুক্তিহীন কথা।

ভাষা না হইলে nation বা জাতি হয় না; এবং ভাষা সম্বন্ধে সচেতন না হইলে, জাতীয়তা-বোধও আসে না। বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি লইয়া অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। যে-সমস্ত উপকরণের সাহায্যে বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তির কথা পুনরুদ্ধার করা যায়, সেগুলি হইতে এইটুকু বুঝা যায় যে, বাঙ্গালা এখন হইতে মাত্র হাজার বৎসর পূর্বে নিজ বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করিয়াছিল। তাহার পূর্বে বাঙ্গালা সৃজ্যমান, তখন বঙ্গদেশের ভাষা অপভ্রংশ ও প্রাকৃত অবস্থায় রহিয়াছে। বাঙ্গালা দেশ হিমাচল-কন্যা গঙ্গার দান; পলিমাটিতেই বাঙ্গালার উদ্ভব। বাঙ্গালা দেশের ভাষাও তেমনি উত্তর ভারতে উদ্ভূত আর্য্যভাষা, প্রাকৃত হইতেই উৎপন্ন। গঙ্গার মতো আর্য্য ভাষার নদী বাঙ্গালা দেশেও বহিল, এই নদীর স্রোতে দেশের প্রাচীন অন্যায্য ভাষা ভাসিয়া গেল— আর্য্য ভাষা প্রাকৃত এই বাঙ্গালায় আসিয়া ক্রমে বাঙ্গালা ভাষার রূপ ধারণ করিল; প্রাকৃতের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ধাত্রী-রূপে সংস্কৃতও আসিল।

মৌর্য্যরাজগণ কর্তৃক বঙ্গ-বিজয়ের পূর্বে, বাঙ্গালা দেশে আর্য্য-ভাষার ও আনুষঙ্গিক উত্তর-ভারতের গাঙ্গ-উপত্যকার সভ্যতার বিস্তার ঘটে নাই বলিয়া অনুমান হয়। মৌর্য্য-বিজয় হইতে আরম্ভ করিয়া গুপ্ত রাজবংশের রাজত্ব পর্য্যন্ত—খ্রীষ্ট-পূর্ব ৩০০ হইতে খ্রীষ্টীয় ৫০০ পর্য্যন্ত, এই আট শত বৎসর ধরিয়া, ভাষায় বাঙ্গালা দেশের আর্য্যীকরণ চলিতেছিল; এই আট শ’ বৎসর ধরিয়া বাঙ্গালার অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়-ভাষী জনগণ নিজ অন্যার্য্য ভাষাসমূহকে ত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে আর্য্য-ভাষা— অর্থাৎ মগধের প্রাকৃত— গ্রহণ করে; উত্তর-ভারতের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সভ্যতা এবং তৎসঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্য— অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় গ্রথিত উত্তর-ভারতের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সভ্যতা এবং তৎসঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্য— অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় গ্রথিত উত্তর-ভারতের আর্য্য ও অনার্য্যের ইতিহাস ও পুরাণ—বঙ্গদেশের অধিবাসীরাও গ্রহণ করিল; বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ আসিল, তাহাও বাঙ্গালায় গৃহীত হইল।
(ক্রমশ)