বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

এই-সব কৃচ্ছ্রতার মধ্যে চড়কের বাণ-ফোঁড়া (পিঠের চামড়া ফুঁড়িয়া লোহার কীল বা শিক চালাইয়া, সেই কীলকে এধার-ওধার করিয়া টানা) একটা বড়ো অনুষ্ঠান ছিল। এই বাণ-ফোঁড়া অবস্থায় ব্রতীকে উঁচু চড়ক-গাছে চড়াইয়া দড়ি ও কাপড়ের সাহায্যে ঝুলাইয়া ঘোরানো হইত; ইহারই নাম ‘চড়ক’। আজকাল কলিাতায় দু-এক জায়গায় ও কলিকাতার বাহিরে কোনও কোনও স্থলে গাজন-উপলক্ষে চড়কের অনুষ্ঠান হয় বটে, কিন্তু বাণ-ফোঁড়া আর নাই, কেবল দড়ি ও কাপড় বাঁধিয়া ঝুলাইয়াই চড়কের সন্ন্যাসীকে ঘোরানো হইয়া থাকে। বাণ ফোঁড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অন্যান্য দেহপীড়াদায়ক ভীষণ অনুষ্ঠানও হইত—জিভ ফুঁড়িয়া শিক বা বাঁশের শলা পুরিয়া দেওয়া, গা বিঁধিয়া চামড়ার মধ্য দিয়া নারিকেল দড়ি চালানো, ইত্যাদি।

কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম পেঁচার নকশা’-তে বাণ-ফোঁড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়—১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দের দিকেও ইহা রীতিমতো প্রচলিত ছিল; চৈত্রে ঢাকের বাদ্য শুনিলেই চড়কির পিঠ সড়-সড় করে, তখন তাহাকে পিঠ ফুঁড়িতেই হয়— এই অর্থে একটি প্রবচন-ও প্রযুক্ত হইত। প্রায় ষাট বৎসর হইল চড়কের এই প্রকার বাণ-ফোঁড়া প্রভৃতি ব্যাপার উঠিয়া গিয়াছে। সমাজ হইতে স্বাভাবিক ভাবেই লোপ পাইয়াছে—বাঙ্গালী নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে শক্তি ও উৎসাহের ক্রমিক বিলোপ এবং তাহাদের সংখ্যা হ্রাস হওয়াই ইহার মুখ্য কারণ। বেল্নস্-গৃহিণী এই ব্যাপার স্বচক্ষে যেমনটি দেখিয়াছেন তেমনি আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছেন, ইহার বর্ণনাও দিয়াছেন।


লাল, বেগুনে ও সবুজ চেলির কাপড় ও সোনার গহনা পরিয়া এবং গলায় ফুলের মালা এবং পায়ে নূপুর ও ঘুহ্গার দিয়া, ঢাকের বাদ্যের সহিত দলে দলে বাণ-ফোঁড়ার সন্ন্যাসীর দল বাহির হইত। সঙ্গে সঙ্গে সঙ সাজিয়া কতকগুলি সন্ন্যাসী যাইত। বেল্নস্-জায়ার চিত্রে পুরুষগুলির সুডৌল দেহ, এবং মাথায় বাবরি চুল, অথবা সব মাথা কামাইয়া একটু ঝুঁটি রাখিবার রীতি লক্ষণীয়। বর্তমান প্রবন্ধে মুদ্রিত চিত্র ২-এ একজন সন্ন্যাসী চেলি ও গহনা পরিয়া হাতে পাখা লইয়া নাচিতেছে, আর এক জনের দুই কাঁধের চামড়া-ফুঁড়িয়া নারিকেল দড়ি চালানো হইয়াছে, সে এই অবস্থায় নাচিতেছে, ও সামনে ও পিছনে দুই জন লোক এই দড়ি ধরিয়া আছে ও তাহার সঙ্গে তাল রাখিতেছে।

এর মধ্যেকার লোকটি বীভৎস কৃচ্ছ্রতা করিতেছে, জিভ ফুঁড়িয়া তাহার ভিতর দিয়া একটি জীবন্ত ঢোঁড়া সাপ চালাইয়া দিয়াছে; আর এক জন জিভের মধ্য দিয়া একটি তিন ইঞ্চি বেড়ের বাঁশ ফুড়িয়া সেটিকে এপাশ ওপাশ করিয়া চালাইতেছে; এবং তৃতীয় ব্যক্তি কাঁখের চামড়া ফুঁড়িয়া রন্ধনকার্য্যে ব্যবহৃত বড় খনতার মতো যন্ত্রের ডাঁটি চালাইয়া দিয়া, খনতার উপরে ধূনা জ্বালাইতেছে।

(ক্রমশ)