পূর্ব প্রকাশিতর পর
তখনকার দিনে ইংরেজ জাতি এ-দেশে মুখ্যতঃ টাকা করিবার উদ্দেশ্যেই আসিলেও, তাহাদের মধ্যে একটু romance, একটু ভাবুকতা, একটু সহৃদয়তা ছিল, ভারতবর্ষের সমস্ত জিনিসকে তাহারা একটু অদ্ভূত দর্শনের, একটু প্রাচীন ও অতি প্রবীণের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব মিশাইয়া দেখিত। ভারতবর্ষের জনসাধারণের দারিদ্র্য ও দুর্দশা তখন আজকালকার মতন এতটা ভয়ংকর হইয়া উঠে নাই; ভারতীয়েরা নিজেদের চিরাচরিত দেশোপযোগী জীবনচর্যাও ভুলে নাই, তাই তাহাদের চলাফেরায় দৈনন্দিন জীবনে কথাবার্তায় একটা স্বাভাবিক সৌষম্য ছিল, শিল্পীর চোখে সেটা ধরা পড়িত।
এই কারণে এখন হইতে এক শত বা আশি বৎসর পূর্বে ইউরোপীয় শিল্পীর হাতে আঁকা ভারতীয় জনগণের চিত্রে আমরা সাধারণতঃ অখুশি হইবার কিছু বড়ো একটা পাই না. আমাদের দেশের লোকের মুখ চোখ প্রভৃতির ভাবটা তাহারা হয়তো ঠিক ধরিতে পারিত না, আমাদের যথার্থ রূপটি হয়তো হুবহু তাহাদের তুলিতে ধরা দিত না,—তাহাদের ছবিতে এইসব নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে অজ্ঞতা এবং অক্ষমতা যথেষ্ট দেখা যায়; কিন্তু সাধারণতঃ এ-দেশের মানুষের প্রতি অবজ্ঞা দেখা যায় না। আজকালকার অনেক ইংরেজ চিত্রকরের আঁকা ভারতীয় সাধারণ স্ত্রীপুরুষের ছবি দেখিলে এই কথার সত্যতা বুঝা যাইবে; যেমন ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের দ্বারা ইংরেজ চিত্রকরের হাত দিয়া আঁকানো কতকগুলি বিজ্ঞাপনের চিত্র—এগুলিতে ভারতীয়দের মূর্তি অতি কুৎসিতভাবে কদাকার করিয়া আঁকা হইয়াছে, ও আঁকনের ভঙ্কিতে ভারতীয়দের সম্বন্ধে একটি বিশেষ ঘৃণার ভাব প্রকাশ পাইয়াছে।
আলোচ্য বেল্নস্-গৃহিণীর ছবিগুলির মধ্যেও তখনকার দিনের ইউরোপীয়দের অঙ্কিত চিত্রের গুণ ও অবগুণ দুই-ই আছে। পোশাক-পরিচ্ছদে কতকগুলি জিনিস তিনি ঠিক ধরিতে পারেন নাই, এইখানে তাঁহার অজ্ঞতা; আর, ইংরেজি চিত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত বলিয়া, তাঁহার আঁকা ভারতীয়দের মুখে, বিশেষ মেয়েদের মুখে, বিলাতি ভাব বহুল পরিমাণে আসিয়া গিয়াছে— সর্বত্র খাঁটি দেশী ভাবটি তিনি ফুটাইয়া তুলিতে পারেন নাই— এইখানে তাঁহার মার্জনীয় অক্ষমতা।
(ক্রমশ)