• facebook
  • twitter
Thursday, 26 December, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

একই ব্যক্তির জীবনে এই সব বিষয়ে কিছু-না-কিছু পরিবর্তন আসিয়া যায়, তাহা যত প্রাচীন-পন্থী এবং স্ব-সংস্কৃতি-নিষ্ঠ সমাজেই হউক না কেন।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর
একই ব্যক্তির জীবনে এই সব বিষয়ে কিছু-না-কিছু পরিবর্তন আসিয়া যায়, তাহা যত প্রাচীন-পন্থী এবং স্ব-সংস্কৃতি-নিষ্ঠ সমাজেই হউক না কেন। এবং যে সমস্ত সমাজে বাহিরের জাতির প্রভাব, অল্প বা অধিক ভাবে আসিয়া পড়িয়াছে, বা যেখানে জাতি নিজ আভ্যন্তরীণ প্রাণধর্মের স্ফূর্তির ফলে নব নব দিকে নিজ শক্তির উন্মেষ খুঁজিতেছে, সেখানে এই সকল বিষয়ে পরিবর্তন আরও অধিক করিয়া ঘটিয়া থাকে। সুতরাং কোনও জাতির সভ্যতার ইতিহাস বা ধারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করিতে হইলে, সে জাতির মধ্যে তাহার জীবনের বিভিন্ন যুগে ব্যবহৃত পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারাদির দিকেও লক্ষ্য রাখিতে হয়। Historical Sense বা ঐতিহাসিক ক্রমের বোধ হইতেছে আধুনিক ইউরোপের একটি বড় আবিষ্কার। ইংরেজী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এই জিনিস ভারতে আমরা পাইয়াছি। কিন্তু এই বোধটিকে এখনও আমরা সর্বত্র আমাদের সাধারণ উচ্চ-শিক্ষার একটী প্রাথমিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। মানব সমাজ কেমন করিয়া পরিবর্তিত হইয়া আধুনিক সমাজে দাঁড়াইয়াছে; বিভিন্ন যুগে মানব-সমাজের বাহ্য রূপটী কি রকম ছিল; ইহা ধারণা করিবার এবং মনশ্চক্ষে ইহার চিত্র কল্পনা করিবার শক্তি, ইতিহাস সম্বন্ধে সত্য জ্ঞানের প্রথম সোপান। আমরা সকলেই চিত্র দর্শন করিতে ভাল-বাসি। জীবনেও মানুষ তাহার চলাফেরা পোষাক-পরিচ্ছদ লইয়া বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন কালে যে চিত্রপট আমাদের চক্ষের সমক্ষে প্রসারিত করে, তাহার প্রতি স্বাভাবিক কৌতূহল দ্বারাই আমরা আকৃষ্ট হই। শিক্ষার কর্তব্য, এই স্বাভাবিক কৌতূহলকে সচেতন করিয়া তাহাকে ঐতিহাসিক-বোধ-প্রসূত জিজ্ঞাসাতে উন্নীত করা— যাহাকে sense of the picturesque in life অর্থাৎ সামাজিক জীবনে যাহা চিত্র-দর্শন-জনিত রস-ভাবকে জাগায় তৎসম্বন্ধে সচেতন ধারণা, বলা যায়, তাহাকে সত্যকার ঐতিহাসিক বোধে পরিবর্তিত করা।

পরিধেয় ও অলঙ্কারাদির আলোচনা এখন ঐতিহাসিক গবেষণার একটী প্রধান অঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কোনও চিত্র বা ভাস্কর্য্যের কাল-নির্ণয়ে যুক্তি-অনুমোদিত রীতিতে এই আলোচনা আমাদিগকে সত্যের সন্ধান বলিয়া দেয়। ইউরোপে এই বিষয়ে এখন বিধি-মত চর্চা হইয়াছে ও হইতেছে; কিন্তু মধ্য-যুগের বা প্রাচীন ইউরোপে লোকে এ বিষয়ে চিন্তা করিত না। চীন ও জাপান এই সম্বন্ধে বরাবরই সচেতন; ভারতবর্ষে ও পারস্যে কিন্তু লোকে এ বিষয়ে এই সম্বন্ধে বরাবরই সচেতন; ভারতবর্ষে ও পারস্যে কিন্তু লোকে এ বিষয়ে কখনও অবহিত হয় নাই। ইতিহাসের দিক হইতে পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারের চর্চা সম্প্রতি মাত্র একটু-একটু ভারতে আরম্ভ হইয়াছে। বঙ্গদেশে এই বিষয়ে শ্রীযুক্ত কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ভারতীয় অলঙ্কার সম্বন্ধে যে গবেষণাপূর্ণ আলোচনা আরম্ভ করিয়াছেন, তাহার দ্বারা ভারতের প্রাচীন সভ্যতার অনেক রহস্য অনেক অজ্ঞাত তথ্য আমাদের নিকট প্রকাশিত হইবে আশা করা যায়। তিনি প্রাচীন-ভারত-বিদ্যায় একটী অত্যাবশ্যকীয় দিক অতি যোগ্যতার সহিত প্রথম হাত দিয়েছেন।
(ক্রমশ)