পূর্ব প্রকাশিতর পর
পোখরণায় কতকগুলি গ্রাম্য দেবতার স্থানে, গাছের তলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং অযত্নে রক্ষিত প্রাচীন প্রস্তরমূর্তির ভগ্নাংশ পড়িয়া রহিায়ছে। এই-সব ভগ্নমূর্তি স্থানটির প্রাচীনত্বের একটি বিশিষ্ট প্রমাণ। আমরা সূর্য্য, গণেশ, অষ্টভূজা মহিষমর্দ্দিনী, বিষ্ণু মস্তকোপরি নাগের ফণযুক্ত কোনও দেবতার, এবং জৈন তীর্থংকর প্রভৃতি দেবতার মূর্তি দেখিয়াছি। এই গ্রামে তিনটি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভগ্ন মূর্তি পাওয়া গিয়াছে, সেগুলি বিশেষ লক্ষণীয়। একটি পোড়া মাটিতে উৎকীর্ণ নারীমূর্তি—এটি কুষাণ যুগের, বা এমন-কি তৎপূর্বকালের হইতে পারে। আর একটি প্রস্তরময় ক্ষুদ্র সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি, মাথাটি ভাঙ্গা, মূর্তিটির বামক্রোড়ে একটি শিশু, বামপার্শ্বে একটি উপবিষ্ট মূর্তি ও একটি অস্পষ্ট পক্ষিমূর্তি; এই উপবিষ্ট দেবীমূর্তিটির ভঙ্গি গুপ্তরাজগণের স্বর্ণমুদ্রায় অঙ্কিত সিংহবাহিনী দেবীর মূর্তির মতো, এবং পক্ষি মূর্তিটি গুপ্তরাজগণের মুদ্রায় অঙ্কিত গরুড়ধ্বজের গরুড়ের অনুরূপ; সুতরাং মূর্তিটি গুপ্তযুগের হইতে পারে। তৃতীয় মূর্তিটি হইতেছে উপবিষ্ট বীণাবাদিনী চতুর্ভূজ সরস্বতী মূর্তি, ক্ষুদ্র আকারের, পাথরে মোটা হাতের কাজে তৈয়ারি; এই মূর্তিটি বিশেষ রহস্যময়,—ইহার রচনারীতি দুই চারিটি বিষয়ে যবদ্বীপের দেবমূর্তি-গঠন প্রণালীর অনুরূপ বলিয়াই মনে হয়।
এই মূর্তিগুলি রায়বাহাদুর শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখ কতকগুলি বিশেষজ্ঞকে দেখানো হইয়াছে, এবং ইঁহারা সকলেই এইগুলির প্রাচীনত্ব স্বীকার করিয়াছেন। (এই মূর্তিগুলি লইয়া ভবিষ্যতে একটি সচিত্র-প্রবন্ধে আলোচনা করিবার ইচ্ছা রহিল।) এইরূপ মূর্তি, ইহাদের প্রাপ্তিস্থান পোখরণার প্রাচীনত্বের ও নানা দিক দিয়া এই স্থানের বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। এতদ্ভিন্ন পোখরণার দক্ষিণে ‘চাঁদাই’ গ্রাম, ‘সিঙ্গাই’ জোড়, এবং ‘চকাই’ গ্রাম প্রাচীন রাজা চন্দ্রবর্মা ও সিংহবর্মার এবং চক্রস্বামী বিষ্ণুর স্মৃতি বহন করিয়া আছে বলিয়া মনে হয়—সম্ভবতঃ সিংহবর্মা ও চন্দ্রবর্মার নাম অনুসারে ‘সিংহাবতী’ ও ‘চন্দ্রাবতী’ নামক স্থানের আধুনিক পরিণতি ‘সিঙ্গাই’ ও ‘চাঁদাই’ এবং হয়তো চক্রস্বামী বিষ্ণুর মন্দির ছিল বলিয়া তৃতীয় স্থানটির নাম ‘চক্রবতী’ বা ‘চকাই’।
পুষ্করণা-পোখরণার স্থান বাঙ্গালীর ইতিহাসে বিশেষ গৌরবের। এখন হইতে পনের শত বৎসর পূর্বে বাঁকুড়া জেলার এই অধুনা-অখ্যাত স্থানটিতে যে একটি স্বাধীন বঙ্গীয় রাজার রাজধানী ছিল, তাহা বুঝা যাইতেছে। চক্রস্বামী বিষ্ণুর পূজা এখানে প্রচলিত ছিল—চৈতন্যদেবের বহুপূর্বে এই অধুনা অরণ্য-সঙ্কুল প্রদেশ বৈষ্ণব ধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। উত্তর বঙ্গের পুন্ড্র নগরের সংবাদ আমরা পাইতেছি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ‘সংবঙ্গীয় লেখ’ হইতে; তাহার পরে, বঙ্গদেশের আর্য্য সভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখ করিতে হয় পুষ্করণা-পোখরণাকে। পোখরণা পূর্ণভাবে অনুসন্ধান হওয়া উচিত। আমাদের জাতির ও সভ্যতার উৎপত্তি ও প্রাথমিক ইতিহাসের অনেক অজ্ঞাত তথ্য এই স্থানেই যে ভূগর্ভের মধ্যে নিহিত আছে সে-বিষয়ে আর সন্দহ নাই।
পরিচ্ছদের ইতিহাস আলোচনা
পরিধেয় এবং অলঙ্কার মানুষের বাহ্য সভ্যতার একটি প্রধান অঙ্গ; মানুষের সভ্যতার অন্তর্জগৎ অর্থাৎ তাঁহার ভাবের জগৎ দীর্ঘকাল ধরিয়া অপরিবর্তিত থাকিয়া চলিতে পারে না, প্রতি পুরুষেই তাঁহার কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। মানুষের সভ্যতার বহির্জগৎ অর্থাৎ তাহার সভ্যতার বাহ্য আশ্রয় বা প্রকাশ বা উপকরণ সম্বন্ধে এই পরিবর্তন-ধর্ম আরও প্রবল। জাতি যে যে অবস্থার মধ্য দিয়া যায়, সেই সেই অবস্থার প্রভাব তাহার ঘর-বাড়ী যন্ত্র-পাতি তৈজস-পত্র গহনা-গাটী কাপড়-চোপড়ের উপরেও পড়িয়া থাকে এবং তাহাদের ঢঙ বদলাইয়া দেয়। মোটামুটী ঠাটটী বজায় থাকিলেও খুঁটীনাটী বদলাইতে দেরী লাগে না।
(ক্রমশ)