পূর্ব প্রকাশিতর পর
খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতকের উৎকীর্ণ লিপি—পুষ্করণ বা পুষ্করণার রাজা সিংহবর্মার পুত্র চন্দ্রবর্মা। এই ‘পুষ্করণ’ বা ‘পুষ্করণা’ কোথায়? স্বর্গীয় শাস্ত্রী মহাশয় (Epigraphia, Indica. XII, p. 37) অনুমান করিয়াছিলেন যে, এই পুষ্করণা রাজপুতনার (রাজস্থানের) অন্তর্গত যোধপুর রাজ্যে অবস্থিত ‘পোখরণ’ নগর। শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মাকে, দিল্লী কুতবমিনার মসজিদের প্রাঙ্গণে প্রোথিত লৌহ-স্তম্ভের লিপিতে যে চন্দ্র রাজার কথা আছে সেই চন্দ্ররাজার সঙ্গে এবং রাজপুতানা ও মালবের বর্ম-বংশীয় অলব্ধপরিচয় সম্ভাব্য এক চন্দ্রবর্মার সঙ্গে অভিন্ন বলিয়া শাস্ত্রী মহাশয় অনুমান করিয়াছিলেন। কিন্তু পোখরণ রাজপুতানা হইতে এত দূরে, অত প্রাচীন কালে (রাজপুতানার) একজন রাজার সেখানে বিষ্ণুচক্র লিপি উৎকীর্ণ করণের কোনও কারণ দেখা যায় না। ওই সময়েই গুপ্তসম্রাটগণের অভ্যুদয় হইয়াছিল—দিল্লীর লৌহস্তম্ভের চন্দ্ররাজা, যিনি বাহ্নীক হইতে বঙ্গ পর্য্যন্ত জয় করিয়াছিলেন, তিনি যে গুপ্ত-বংশীয় সম্রাটগণেরই একজন, হয়তো বা তিনি গুপ্তবংশীয় প্রথম বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই হইবেন, এইরূপ অনুমানও করা হইয়াছে; এবং সেই অনুমানের পক্ষে যুক্তি আছে। যাহা হউক, আমাদের এই ‘পুষ্করণা’ শুশুনিয়া-পাহাড়ের নিকটবর্তী রাঢ় অঞ্চলেরই কোনও স্থান হইবে, এইরূপ মত কেহ কেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে সরকারি প্রত্নানুসন্ধান বিভাগের উচ্চতন কর্মচারী শ্রীযুক্ত কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিত মহাশয় অন্যতম—ইঁহার মতে, বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত ‘পোখরণা’ (বা ‘পখরণা’) গ্রাম-ই প্রাচীন ‘পুষ্করণা’। এই মত আমি আমার Origin and Developmengt of the Bengali Language (১৯২৬ সালে প্রকাশিত) পুস্তকে গ্রহণ করিয়াছি। ‘পোখরণা’ দামোদর নদের দক্ষিণতীরবর্তী, ঈসট্-ইন্ডিয়ান রেলওয়ের রাজবাঁধ স্টেশনের দক্ষিণে দামোদরের উত্তরে অবস্থিত আমলাজোড়া গ্রামের অপর পারে অবস্থিত, এবং শুশুনিয়া পাহাড় হতে ২৫/২৬ মাইর পূর্বে। ‘পুষ্করণা’ হইতে ‘পোখরণা’ নামের উদ্ভব অতি সহজেই হইয়াছে।
অনুমান হয়, পুষ্করণার এই রাজা চন্দ্রবর্মা গুপ্ত-সম্রাট্ সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক বিজিত হইয়াছিলেন। প্রয়াগ অশোক-স্তম্ভের গাত্রে উৎকীর্ণ সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তিতে যে বিজিত চন্দ্রবর্মা নামক রাজার উল্লেখ আছে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের পুষ্করণা-জনপদের রাজা, আমাদের শুশুনিয়া পাহাড়ের চন্দ্রবর্মা হওয়াই সম্ভব।
বাঁকাড়া জেলার কতকগুলি স্থান পরিভ্রমণ কালে বিগত ২১-এ মাঘ (৩রা ফেব্রুয়ারি) আমার পোখরণা গ্রামে যাইবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন ও আমি, আমরা উভয়ে এখন চন্ডীদাস-পদাবলী সম্পাদনে নিযুক্ত। এই কার্য্য-সম্পর্কে আমাদের বীরভূম-নানুর যাইতে হইয়াছিল। এবং বাঁকুড়া-ছাতনার সহিত চন্ডীদাসের সংযোগের কথা বিদ্যমান থাকায়, ছাতনা পরিদর্শন করিয়া আসাও আমাদের কর্তব্য বলিয়া মনে হইয়াছিল। বাঁকুড়ার কতকগুলি গ্রামে বৈষ্ণব পদের পুঁথি অন্বেষণ করা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
পোখরণা গ্রাম গিয়া গ্রামটি দেখিয়া আমাদের দৃঢ় ধারণা হইয়াছে যে পোখরণা প্রাচীন পুষ্করণা-ই বটে। পোখরণায় স্থানীয় জমিদার শ্রীযুক্ত কালীভূষণ মুখোপাধ্যায় ও পার্শ্ববর্তী পলাশডাঙ্গা গ্রামের হাই-ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত ভোলানাথ ঘোষ মহাশয়ের সহিত হরেকৃষ্ণবাবু ও আমি প্রাচীন গড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখি। স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে, বহুপূর্বে এই গড়ে এক স্বাধীন রাজা বাস করিতেন। গড়ের স্থানে কতকগুলি উঁচু ভিটি আছে, সেগুলি খনন করিয়া দেখিবার যোগ্য। গড়খাইগুলি এখন পুষ্করিণীতে পরিবর্তিত হইয়াছে—প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে এইরূপ একটি পুষ্করিণীতে সিন্দুকের আকারে সাজানো বৃহদাকার কতকগুলি প্রস্তর-ফলক পাওয়া গিয়াছিল। এখনও এই ‘গড়ের ডাঙ্গা’ হইতে মাঝে-মাঝে মূর্তি আদি নাকি পাওয়া যায়, তবে প্রাপ্ত মূর্তিগুলিকে এতাবৎ কেহ রক্ষা করে নাই; এবং এতদ্ভিন্ন মোহর ও অন্যান্য মুদ্রাও নাকি পাওয়া গিয়াছে।
(ক্রমশ)