• facebook
  • twitter
Thursday, 5 December, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

এই ‘বাঙ্গ্লা’ শব্দকেই আবার হিন্দীতে লেখা হয় ‘বংলা’, বঁগলা, বঙ্গ্লা’ রূপে। ফরাসীর ‘বঙ্গালহ্’ হইতে খ্রীষ্টীয় ১৫০০-র পর হইতে নানা ইউরোপীয় ভাষায় Bengala, Bengalla, Bengall, Bengal প্রভৃতি, এবং দেশের লোক জানাইতে Bengalese, Bengalee, Bengali প্রভৃতি রূপ প্রযুক্ত হইতে থাকে।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

‘বঙ্গালহ্’—এই ‘বিস্তৃত’ রূপ, মিলিতভাবে গৌড়-বঙ্গ উভয় অঞ্চলের জন্য গৃহীত হইয়া যায়; এবং ‘বঙ্গালহ্’ (উচ্চারণে ‘বঙ্গালা’) শব্দের উত্তর বিশেষণার্থে ‘ঈ’ প্রত্যয় যোগ করিয়া ‘বঙ্গালী’—সারা বাঙ্গালার অধিবাসী। কিন্তু কেবল পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী অর্থে ‘বঙ্গাল’ শব্দ প্রচলিত থাকে—আধুনিক কালে বাঙ্গালীর মুখে ইহার উচ্চারণ দাঁড়াইয়াছে বাঙ্গাল (পূর্ব-বঙ্গে), ও ‘বাঙাল’ (পশ্চিম বঙ্গে)। বাঙ্গালীর মুখে আর কয়েকটি সংক্ষিপ্ততর রূপ শোনা যায় ‘বাঙ্গালা’ হইতে ‘বাঙ্গ্লা’, ‘বাঙ্লা’ (‘বাংলা’)— প্রথম অক্ষরের উপরে প্রবল বলাঘাতের ফলে, দ্বিতীয় অক্ষরের ‘আ’ স্বরধ্বনির লোপ ঘটে। এই ‘বাঙ্গ্লা’ শব্দকেই আবার হিন্দীতে লেখা হয় ‘বংলা’, বঁগলা, বঙ্গ্লা’ রূপে। ফরাসীর ‘বঙ্গালহ্’ হইতে খ্রীষ্টীয় ১৫০০-র পর হইতে নানা ইউরোপীয় ভাষায় Bengala, Bengalla, Bengall, Bengal প্রভৃতি, এবং দেশের লোক জানাইতে Bengalese, Bengalee, Bengali প্রভৃতি রূপ প্রযুক্ত হইতে থাকে।

‘বঙ্গ’ প্রথমটায় কেবল পূর্ব বঙ্গ সম্বন্ধে প্রযোজ্য ছিল বলিয়া, সারা দেশের জন্য ফারসী ভাষার কল্যাণে ‘বাঙ্গালা (বাঙ্লা), বাঙ্গালী (বাঙালী)’ দাঁড়াইয়া গেলেও, পূর্ব-বঙ্গ-বর্জ্য কেবল পশ্চিম বঙ্গের জন্য ‘বঙ্গদেশ’ শব্দের ব্যবহার সমীচীন ও সংগত হইবে না, ঐতিহাসিক ও ব্যবহারিক উভয় দৃষ্টিতেই। সেইজন্য পুরাতন নাম ‘গৌড়-বঙ্গ’ এই যুগ্ম-নাম, ব্যবহার করিলে—অন্ততঃ আনুষ্ঠানিক ব্যাপার উপলক্ষ্যে—দুইটি পুরাতন নামেরই স্মৃতি ও মর্য্যাদা উভয়-ই রক্ষিত হয়।

মধ্য যুগের বাঙ্গালায়, বিশেষ করিয়া পশ্চিম বঙ্গের মানুষের জন্য ‘গৌড়ীয়া’ শব্দ ব্যবহৃত হইত। শ্রীচৈতন্যের জীবৎকালে, নবদ্বীপ বা পশ্চিম বঙ্গের কোনও স্থান হইতে কেহ পুরীধামে উপস্থিত হইলে, ‘গৌড়িয়া’ বলিয়া অভিহিত হইতেন, ‘বাঙ্গালী’ বলিয়া নহে। ‘গৌড়িয়া’ শব্দের এই প্রয়োগ অন্যত্রও পাওয়া যায়। রাজা রামমোহন রায় তাঁহার বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণকে ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ বলিয়া গিয়াছেন। মধুসূদন তাঁহার ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে লিখিয়া গিয়াছেন— ‘‘কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু / লয়ে, রচ, মধুচক্র, গৌড়জন যাহে / আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।’’ যশোহর জেলার তাঁহার জন্মস্থান ছিল, কিন্তু সমগ্র বঙ্গভাষী (বা গৌড়ীয়-ভাষী) জনের জন্য ‘‘গৌড়-জন’’ শব্দ-ই তিনি প্রশস্ত মনে করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু পোর্তুগীস পাদ্রি মানো এল্-দা-আস্সুম্প সাওঁ বঙ্গ ভাষার জন্য Bengalla শব্দ-ই লিখিয়াছেন (১৭৪৩ খ্রীস্টাব্দে লিসবন-নগরীতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত)। তদ্রূপ ইংরেজ নাথানিএল্ ব্রাসি হাল্হেড্ তাঁহার Grammar of the Bengal Language প্রকাশিত করেন (১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে, হুগলি হইতে প্রকাশিত)। ইংরেজ বাপইটস্ট পাদ্রিরা যখন শ্রীরামপুর হইতে কৃত্তিবাসের বাঙ্গালা রামায়ণ প্রথম প্রকাশিত করেন, তখন পুস্তকের নামপত্রে এইরূপ মুদ্রিত হয়—‘‘কৃত্তিবাস বাঙ্গালি ভাষায় রচিল।’’

ইহা-ই হইল ‘গৌড়’ ও ‘বঙ্গ’ নাম দুইটির মোটামুটি ইতিহাস। এই দুইটি নাম-ই গৌড়-বঙ্গ-বাসী সমস্ত বঙ্গ-ভাষীর প্রিয়।
(ক্রমশ)