বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

কিন্তু তাহাতে যে বিশেষ উদ্দেশ্য-সিদ্ধি হইতেছে, তাহা বলা যায় না— পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমান আরও আগ্রহের সহিত, এমন কি প্রাণ দিয়াও, তাঁহাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালার মর্যাদা বজায় রাখিতেছেন।

‘‘বঙ্গ-দেশ’’ বলিলে প্রাচীনকালে সাধারণভাবে মাত্র পূর্ব বঙ্গেরই কতকগুলি অঞ্চল বুঝাইত, সারা বাঙ্গালা দেশে নহে। বাঙ্গালা ভাষা গড়িয়া উঠিবার কালে, এবং তাহার পরে কয়েক শত বৎসর ধরিয়া, বঙ্গভাষী জনগণের নিবাস-ভূমি দুইটি প্রধান নামে অভিহিত হইত ‘গৌড়’ ও ‘বঙ্গ’ (বা ‘বঙ্গাল’)। উত্তর বঙ্গ (বরিন্দ বা বরেন্দ্র-ভূমি—রাজশাহী, মালদহ, বগুড়া, পাবনা) ও রাঢ় এবং সুহ্ম (পশ্চিম বংগ—বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর)— এই অঞ্চলগুলি লইয়া ‘গৌড়দেশ’, প্রাচ্য বাঙ্গালায় ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কাছাড়, কুমিল্লা (পট্টিকেরা) ও চট্টল কতকগুলি বিভাগ জন সমাজে প্রচলিত ছিল—রাঢ়, সুহ্ম, ঝাড়খণ্ড (মানভূম, পুরুলিয়া, সিংহভূম), কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা, বরেন্দ্র সমতট, বাগড়ী (সুন্দরবন অঞ্চল), বঙ্গ, কোচবিহার, কামতাবিহার, ময়মনসিংহ, চট্টল, ত্রিপুরা প্রভৃতি। বঙ্গভাষী জনের প্রভাবে ইহার কতকগুলি অঞ্চল আসিলেও, সেদিন পর্যন্ত সেগুলি মুখ্যতঃ ভোট-চীন শ্রেণীর মানুষেরই বাসভূমি ছিল—যেমন কোচবিহার, পূর্ব ময়মনসিংহ, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিঙ, এবং ওদিকে ত্রিপুরা।


‘‘গৌড়’’ ও ‘‘বঙ্গ’’—প্রধানতঃ এই দুই বিশিষ্ট প্রদেশ লইয়া আজকার অখিল বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাঙ্গালা বা বাঙ্গলা। এই দুইটি নাম-ই বিশেষ প্রাচীন, এ দুটি খ্রীষ্টপূর্ব যুগে গিয়া পৌঁছায়। মহাভারতে আমরা ‘গৌড়’ ‘বঙ্গ’ দুইটি নাম-ই পাই। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে প্রাচ্য দেশের নগর রূপে ‘গৌড়পুর’ পাওয়া যায় (পুরে প্রাচাম্। অরিষ্ট-গৌড়-পূর্বে চ।’ —৬।২।৯৯-১০০), যদিও বঙ্গের উল্লেখ নাই। ‘‘অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ’’—এই তিনটি নাম একত্র পাই, তিনটি বিভিন্ন অনার্য (সম্ভবত কোল-ভাষী) উপজাতির নাম; এই তিনটি উপজাতি পরস্পর ঘনিষ্টভাবে সম্বন্ধ ছিল, ইহাদের উৎপত্তি এক-ই ছিল। ‘গৌড়’ নামটির কোনও সর্ব-জন-মান্য ব্যাখো নাই। গুড়ের দেশ বলিয়া ‘গৌড়’ নাম, এইরূপ একটি মত আছে; ‘পুন্ড্র বর্ধন’ (আধুনিক ‘পান্ডুয়া’—‘পেঁড়ো’) বরেন্দ্রভূমির একটি বিশিষ্ট স্থানের নাম, ‘পুড়’ আখের জায়গা। সুতরাং এই হিসাবে ‘গুড়’ হইতে ‘গৌড়’ হইতে বাধা নাই। কিন্তু ‘গৌড়’ নামটি বহুশঃ বরেন্দ্র-ভূমের মালদহ রাজশাহী প্রভৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা সত্ত্বেও, ইহার একটি ব্যাপক প্রয়োগ আছে।

(ক্রমশ)