পূর্ব প্রকাশিতর পর
পূর্ব বঙ্গের ভাষা, পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন নাম ধরিয়া ‘বাংগাল’ ভাষা বলিয়া পশ্চিম বঙ্গের জনসাধারণের কাছ পরিচিত ছিল।
দেশ-বিভাগের পূর্বে, এবং বিশেষ করিয়া দেশ-বিভাগের পরে, পূর্ব বঙ্গের মানুষ প্রচুর পরিমাণে পশ্চিম বঙ্গে আসিয়া বসবাস করিতে আরম্ভ করায়, এখন পশ্চিম বঙ্গের ভাষার উপরে পূর্ব বঙ্গের প্রভাব খুব অধিক পরিমাণে আসিয়া গিয়াছে ও যাইতেছে; যেমন পশ্চিম বঙ্গের ভাষার প্রভাব বাঙ্গালা ভাষার সৃষ্টির সময় হইতেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাবে পূর্ব বঙ্গের ভাষাকেও গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করিয়াছিল।
‘‘পূর্ব বঙ্গ’’ ও ‘‘পশ্চিম বঙ্গ’’— সমগ্র বঙ্গদেশের এই দুই বিভাগ যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারিভাবে গৃহীত হয় নাই, ততক্ষণ পর্যন্ত তাহার দ্বারা বঙ্গভাষী জনগণের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক একতাবোধে কোনও দাগ পড়ে নাই। লর্ড কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গ-ভঙ্গের উদ্দেশ্য ছিল, অখণ্ড বঙ্গদেশকে দুই খণ্ড করিয়া দুইটি পৃথকভাবে শাসিত প্রদেশে পরিণত করিয়া, বাঙ্গালাদেশ ও বঙ্গভাষী জনগণকে আর একতাবদ্ধ ও সুসংহত না রাখিয়া, খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া। সমগ্র বঙ্গভাষী জাতির, বিশেষতঃ হিন্দু বাঙ্গালীর—প্রতিরোধের ফলে, এই অপচেষ্টা কার্যকর হইল না— ১৯১১ সালে বঙ্গভাষী জাতি ও এক প্রদেশের মধ্যে পুনরায় সংগ্রথিত হইল।
পাকিস্থানের স্থাপনের পরে, ‘‘পশ্চিম বঙ্গ’’ ও ‘‘পূর্ব বঙ্গ’’, এই দুইটি খণ্ডদেশরূপে অবিভক্ত বঙ্গদেশ আবার দেখা দিল। যত দিন ‘পশ্চিম বঙ্গ’ বা ‘পশ্চিম বাঙ্গালা’ এবং ‘পূর্ব বঙ্গ’ বা ‘পূর্ব বাঙ্গালা’ এই দুইটি নাম থাকিবে, ততদিন একটি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী বঙ্গভাষী জাতির পূর্বস্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ আশাও হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালীর মন হইতে একেবারে মুছিয়া যাইতে পারিবে না। ‘পশ্চিম বঙ্গ’ (‘ওয়েস্ট্ বেঙ্গল’) বলিলেই, সংগে-সংগে তাহার জবাব-রূপে ‘পূর্ব বংগ’ (বা ‘ঈস্ট্ বেংল’) নামটিও আপনা-হইতেই আসিবে। সমগ্র বঙ্গদেশ সম্বন্ধে এই ঐক্যবোধকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্যই, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ্ হইতে প্রতিবাদ করা হইয়াছিল—মাঝে যে-প্রস্তাব উঠিয়াছিল যে ‘পশ্চিম বংগ’ (ওয়েস্ট্ বেঙ্গল’) নামটিকে বর্জন করিয়া তাহার স্থানে কেবল ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাঙ্গালা দেশ’ (বেঙ্গল) বলা হউক, ভারত-সরকারও এই নাম গ্রহণ করুক,—তাহা অনুচিত, অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক, এবং দেশাত্মবোধের পরিপন্থী; অতএব এই প্রস্তাব পরিত্যক্ত হউক। সুখের বিষয়, ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামটি বিতাড়িত করিবার প্রস্তাবটি সম্বন্ধে এই আপত্তি উঠায়, ইহা গৃহীত হয় নাই। বংগভাষী মুসলমানগণের মন হইতে তাঁহাদের ভাষাও জাতি-বিষয়ক গৌরববোধকে (যাহা ধর্ম-বিষয়ক গৌরব-বোধ হইতে পৃথক্ তাহাকে) অবলুপ্ত করিয়া দিবার সাধন-হিসাবে, পাকিস্থান সরকার ‘পূর্ব বঙ্গ’ (‘ঈষ্ট-বেঙ্গল’) নামটির পরিবর্তে কেবল ‘পূর্ব পাকিস্থান’-ই ব্যবহার করিতেছেন।
(ক্রমশ)