পূর্ব প্রকাশিতর পর
তাদের ঘর-গৃহস্থালির যন্ত্রপাতিও এক ধরনের, চাষবাসের জিনিসপত্র গঠনের পদ্ধতিও এক ধরনের, তাদের সাহিত্য-শিল্প-সংগীতও এক ধরনের। অবশ্য এ-সবের পিচনে একটা সাধারণ ভারতীয়তার ছাপ আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা রঙ্ও তার আছে। বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে মানসিক-প্রবৃত্তিগত প্রকৃতিগত মিল পাওয়া যাবে বাঙালী হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টানের সঙ্গে, পাঠান বা তুর্কী বা আরব মুসলমানের সঙ্গে নয়। ধর্মজগতেও সেই একভাব বিদ্যমান, তার বাইরের পোশাকটাকে যতই বদলাবার চেষ্টা হোক না কেন।
বাঙালীর পূর্বপুরুষ যখন বৌদ্ধ হিন্দু বা মুসলমান-এর একটাও ছিল না, দ্রাবিড় নিষাদ আর কিরাতের আদিম ধর্ম যখন সে পালন ক’রত, তখন সে আলৌকিক-শক্তিশালী ধর্মগুরুতে বিশ্বাস ক’রত। এই প্রকার গুরুর মৃত্যুর পর তার দেহ মাটিতে পুঁতে তার উপর মাটি বা পাথরের ঢিবি সাজিয়ে দিত, সমাজের মঙ্গলের জন্য সপ্তাহে একদিন ঢিবি পরিষ্কার ক’রত, তাতে ফুল দিত, সুগন্ধি দিত, প্রদীপ জ্বালাত। এই ঢিবিকে ব’লত ‘এড়ুক’। পরে এই ‘এড়ুক’ হ’ল বৌদ্ধের হাতে ‘স্তূপ’ বা ‘চৈত্য’, হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হাতে সাধু সন্তের ‘‘সমাধি’’ আর ধর্মান্তরিত বাঙালী মুসলমানের হাতে তার রূপ হ’ল বা নামকরণ হ’ল ‘পীরের কবর’ বা ‘দরগা’ বা ‘আস্তানা’।
সংক্ষেপে পূর্বাপর বাঙালী জাতি বা জনের গঠনের ইতিহাসের ধারাটা এখন বলা যাক। ভারতে তথা বাঙলায় মানুষের বাস প্রথমটায় ছিলই না। বাইরে থেকে ভারতের অধিবাসীদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে আরম্ভ করে, স্মরণাতীত কাল তেকে—প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। প্রথম আসে আফ্রিকা থেকে নিগ্রোজাতীয় মানুষ। আফ্রিকার পরে আরবদেশ আর ঈরানের সাগরকূল ধ’রে এরা দক্ষিণ বেলুচিস্থান হ’য়ে ভারতে আসে। আর ঈরানের সাগরকূল ধ’রে এরা দক্ষিণ বেলুচিস্থান হ’য়ে ভারতে আসে। বাঙলা দেশেও এদের আগমন হয়, কিন্তু পরবর্তী কালের মানুষ, যারা আসে তাদের হাতে এরা বিধ্বস্ত হ’য়ে যায়। বাঙলা হ’য়ে আসাম, তার পরে বর্মা, বর্মা থেকে ডাঙ্গার রাস্তায় মালয়দেশ, আর ডোঙ্গা ক’!রে সাগর পেরিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ— এই-সব দেশে নিগ্রোজাতীয় মানুষের প্রসার হয়, কিন্তু বাঙলায় এদের আর অস্তিত্ব নেই।
(ক্রমশ)