বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

আমরা অনুচিত গর্ব করিতে চাহি না; তবে যে-কোনও অবস্থায় আমরা যে অকৃতকার্য্য হইব না, আমরা পূর্ব কৃতিত্ব আলোচনা করিয়া সেইটুকুই আত্মবিশ্বাস আমাদের প্রত্যেকের মনে আনিতে চাহি।

প্রবন্ধ দীর্ঘ রইয়া পড়িল। শেষ এই কথা বলি— অনার্য্য এক আর্য্য পিতৃপুরুষ ও সংস্কৃতি-গুরুদের নিকট হইতে আমরা বাঙ্গালীরা যে-মনঃপ্রকৃতি পাইয়াছি, তাহা নিন্দার নহে; আমাদের নৈসর্গিক পারিপার্শ্বিক ও ইতিহাসকে আশ্রয় করিয়া আমাদের মধ্যে যে-সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা এখনও পূর্ণাঙ্গও হয় নাই—আমাদের সমস্ত জ্ঞান ও কর্ম দিয়া তাহাকে প্রবর্ধমান করিয়া তুলিতে হইবে। উপস্থিত আমাদের মানস-প্রকৃতিতে কল্পনা ও ভাবুকতা এবং রসানন্দের দিকে ঝেঁাক না দিয়া, আত্মরক্ষার জন্য আমাদের জ্ঞান ও কর্মের দিকেই বেশী করিয়া ঝোঁক দিতে হইবে— ইহা-ই আমার নিবেদন।।
বাঙ্গালীর ইতিবৃত্ত : জাতি গঠনে


ইংরিজির caste, tribe, race, people, nation প্রভৃতি শব্দের মতো বিশিষ্ট অর্থে এখনও আমরা বিভিন্ন শব্দ আমাদের ভারতীয় ভাষাগুলিতে ব্যবহার করি না— এক ‘জাতি’ শব্দ নিয়ে আমরা এতগুলি বিভিন্ন অ্র্থের শব্দের কাজ বাঙলা প্রভৃতি ভাষাতে চালাবার চেষ্টা করি। Nation অর্থে ‘রাষ্ট্র’ শব্দ চ’লতে পারে। People-এর জন্য ‘জনগণ’ বা ‘জন’। Caste-এর জন্য ‘বর্ণ’ শব্দ তো আছেই। Race-এর জন্য ‘জাতি’, Tribe-এর জন্য ‘উপজাতি’। আমাদের ভারতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে—Indian Nation-এর মধ্যে, কতকগুলি বিশিষ্ট people বা ‘জন’-এর স্থান আছে। এক ভাষা ব্যবহার করা সমগ্র ভারতীয় রাষ্ট্রের বিশিষ্ট লক্ষণ নয়, যদিও ইংরিজি সংস্কৃত হিন্দী প্রভৃতির যোগে আমাদের একভাষিতার অভাবকে আমরা কার্য্যতঃ পূরণ ক’রে নিয়েছি। ভারতবর্ষে যে-বিভিন্ন people বা জনগণ বা জনসমূহ আছে, তাদের মধে প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হ’চ্ছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা; আর সঙ্গে-সঙ্গে, সেই ভাষাকে আশ্রয় ক’রে, তাদের মানসিক culture বা সংস্কৃতি, সেই ভাষা য়ার প্রকাশভূমি এমন তাদের জীবনযাত্রা রীতিনীতি সামাজিক পদ্ধতি।

এক কথায়, ভারত-রাষ্ট্রের সঙ্গে কতকগুলি Language-Culture Group অর্থাৎ বিশিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতি-যুক্ত কতকগুলি দল বা জনকে ধ’রতে হয়। এই সমস্ত দল বা জন হ’চ্ছে এক বৃহৎ বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত কতকগুলি ছোটো ছোটো বৃত্ত। ভারতরাষ্ট্রের ভিতরে যে-সব people বা Language-Culture Group অথবা ভিন্ন ভিন্ন ভাষাবলম্বী জনসমূহ আছে, বাঙালী জন—‘গৌড়জন’ ব’লে মধুসূদন তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যে যার উল্লেখ ক’রেছেন, সেই ‘বাঙালী’ বা ‘গৌড়জন’ একটি অন্যতম প্রধান দল বা শ্রেণী বা জন। বাঙালীর পাশে এইরূপ ‘অসমিয়া জন’ আছে, ‘ওড়িয়া জন’ আছে, ‘মৈথিল’, ‘মহগী’, ‘ভোজপুরিয়া’, ‘কোসলী’, ‘পছাঁহী’, ‘পূর্বী-পাঞ্জাবী’, ‘রাজস্থানী’, ‘গোরখালী’, ‘গাড়োয়ালী’, ‘কুমাউনী’, ‘গুজরাটী’, ‘সিন্ধী’, ‘কাশ্মীরী’, ‘মারাঠী’, ‘তেলুগু’, ‘তমিল’, ‘কানাড়ী’, ‘মালায়ালাম’, ‘গেড়ি’, ‘ওরাওঁ’, ‘মুন্ডা’, ‘সাঁওতালী, ‘গারো’, ‘মণিপুরী’, ‘খাসিয়া’ প্রভৃতি নানা জনগণ আছে। পাঁচ ফুলের সাজির মতো এই-সব বিভিন্ন-ভাষাশ্রয়ী জন নিয়েই মিলিতভাবে ভারতীয় রাষ্ট্র।

(ক্রমশ)