পূর্ব প্রকাশিতর পর
(৩) বাঙ্গালী কর্মী নহেত, তাহার এই একটা অপবাদ আছে। সত্য বটে, হাজারে-হাজারে লাখে লাখে, বাঙ্গালী অন্ন-উপার্জনের জন্য বাহ্গালাদেশ ছাড়িয়া বাঙ্গালার বাহিরে যায় নাই— যেমন পাঞ্জাবী বা হিন্দুস্থানীরা বাঙ্গালায় আসিয়া থাকে। ইহার কারণ এই যে, এতাবৎ বাঙ্গালীর ঘরে একমুঠা ভাতের অভাব হয় নাই। সেদিন পর্য্যন্ত মধ্যবিত্ত ঘরের অন্নচিন্তা ছিল না। গরিব লোকে দেশে বসিয়াই পেট ভরাইতে পারিত, বা আধ-পেটা খাইয়া কোনও রকমে থাকিতে পারিত, ১৫/২০ টাকার জন্য কাঁচা মাথা দিবার আবশ্যকতাতাহার ছিল না, ‘রুটি-অর্জর্ন করিতে বাহিরে ছুটিতে হইত না। এখন সে আবশ্যকতা আসিতেছে। আমার মনে হয়। তথাকথিত ভাব-প্রবণ বাঙ্গালী, কবি বাঙ্গালী এখন দরকার পড়িলে কর্মী বাঙ্গালী হইতে পিছপাও হইবে না। আবশ্যকতা পড়িয়াছে বলিয়াই ময়মনসিংহের বাঙ্গালী কৃষক এখন ঘর ছাড়িয়া আসাম প্রদেশ ছাইয়া ফেলিতেছে, বর্মা ও শ্যামে গিয়া বসবাস করিতেছে। দেখা গিয়াছে, কার্য্যক্ষেত্রে বাঙ্গালী অন্য জাতির লোকেদের চেয়ে কিছু কম কৃতিত্ব দেখায় নাই। মানুষের কর্ম-শক্তি আভ্যন্তর urge বা তাড়নার উপরে নির্ভর করে। বাঙ্গালীর অবস্থা-বৈগুণ্যে সে তাড়না আসিতেছে। বাঙ্গালীকে নূতন করিয়া শ্রমী ও কর্মী হইতেই হইবে। ‘তুমি কবি ও ভাবুকের জাতি, তোমার দ্বারা এ-সব কিছু হইবে না’, এইরূপ নিরুৎসাহ-বাক্যে তাহার শত্রুরাই তাহাকে নিবৃত্ত করিবে।
(৪) বাঙ্গালীর বাঙ্গালীপনার বা বাঙ্গালীত্বের দিকে ঝোঁক দিয়া কেহ কেহ তাহাকে অসম্ভব রকমে বাড়াইয়া তুলিয়া তাহার মনে শক্তি জাগাইবার চেষ্টা করিতেছেন। বাঙ্গালীর মতন শিল্পী জাতি দুনিয়ায় নাই—প্রমাণ, বাঙ্গালী পটুয়ার পট, বাঙ্গালী ছুতারের নাচ অপূর্ব—প্রমাণ, বাঙ্গালীর মল্লনৃত্য, রায়বেঁশে নাচ, বাঙ্গালার কোনও কোনও জেলার মেয়েদের মধ্যে বিলোপ-শীল ব্রত-নৃত্য। আমাদের দেশের গ্রাম-শিল্পকে আমরা প্রাণ দিয়া ভালোবাসিব, যতটা সাধ্য তাহাকে রক্ষা করিব। এই শিল্প আমাদের গ্রামীণ জীবনের একটি মনোহর অভিব্যক্তি, কিন্তু তাই বলিয়া, জগতের অন্য সমস্ত শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর জিনিসকে টেক্কা দিয়াছে আমাদের বাঙ্গালার এই শিল্প ও সৌন্দর্য্য-সৃষ্টি এরূপ কথা প্রত্যেক চিন্তাশীল বাঙ্গালীর মুখে হাস্যের উদ্রেক করিবে। সাহিত্যে একজন রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গমাতা অঙ্কে ধারণ করিয়াছেন, তাই বলিয়া যেমন ইহা প্রমাণিত হয় না যে, বাঙ্গালী মাত্রই কবি, তেমনি একজন অবনীন্দ্র বা নন্দলাল ভারতীয় নিজ হস্ত হইতে তুলিকা পাইয়াছেন বলিয়া, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির শিল্প-বিষয়ে অসাধারণত্ব সূচিত হয় না।
আমরা ভারতের আর পাঁচটি জাতির মতোই একটি প্রধান ভারতীয় জাতি। আমাদের ভাবুকতা আছে, আমাদের বৃদ্ধি আছে, আমাদের যথেষ্ট শিল্প-বোধ আছে; ভারতের সভ্যতার ভাণ্ডারে হাত পাতিয়া আমরা কেবল লই নাই, দিয়াছিও যথেষ্ট; আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংগীত, আমাদের বিদ্যা, গবেষণা ও আবিষ্কার, আমাদের হিন্দু-যুগের ও মধ্য-যুগের মন্দির-শিল্প ও ভাস্কর্য্য, পট ও ইটে-খোদাই—এ সব গর্ব করিবার বস্তু, ভারতের সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট প্রকাশ-স্বরূপ এগুলি বিশ্ব-জনসমাজে দেখাইবার যোগ্য; এবং আমাদের সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব কোনও কোনও বিষয়ে বিশ্বজনও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিয়াছি, ও করিবে; এইখানেই আমাদের পূর্ণ সার্থকতা।
(ক্রমশ)