পূর্ব প্রকাশিতর পর
যে-দুই-চারি জন বড়ো বড়ো আলেম, মোল্লা ও মৌলবী বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে হইতেন, তাঁহারা নিজেদের আরবী-ফারসী কেতাবের মধ্যেই নিমগ্ন থাকিতেন, বাঙ্গালা ভাষার চর্চা তাঁহারা বড়ো একটা করিতেন না; ফলে, আরবী-ফারসী জগতের খবর বাঙ্গালীর কাছে বেশি করিয়া পৌঁছায় নাই। কিছু কিছু আরবী প্রার্থনা, মুসলমানি স্মৃতি-শাস্ত্রের কথা, এবং মুসলমানি ইতিহাস-পুরাণ কেচ্ছা-কাহিনী বাঙ্গালায় অনূদিত হইয়াছিল, এইটুকু মাত্র। উত্তর-ভারতের এবং ভারতের বাহিরের দেশের মুসলমান সংস্কৃতির সহিত এবং কোরান-অনুমোদিত ইসলামের সহিত বাঙ্গালী মুসলমান অতি আধুনিক কালে— বিগত মাত্র ২৫/৩০ বৎসর মধ্যে— একটু ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাইবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু নানা কারণে তাহার জীবনে সে-পরিচয় কার্য্যকর হইতেছে না।
ফরমাইশ দিয় ইচ্ছামতো ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ তৈয়ার করা চলে না। বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে যেটুকু মুসলমান প্রভাব বিদ্যমান, ধীরে-ধীরে এই পাঁচ ছয় সাত শত বৎসর ধরিয়া, ইসলামগত-প্রাণ পূর্ণবিশ্বাসী আলেম মোল্লা মৌলবাদীদের চেষ্টাতেই হইয়াছে। সম্প্রতি বাঙ্গালী মুসলমানদের কেহ-কেহ যেভাবে বাঙ্গালায় ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ আনিবার চেষ্টা করিতেছেন তাহার মধ্যে positive অর্থাৎ সংগঠনকারী দিক্ অপেক্ষা negative অর্থাৎ ধ্বংসকারী দিকটাই প্রবল। ইঁহাদের কাছে ইসলামীয় মনোভাব মানে মুখ্যতঃ যাহা ভারতীয়ত্বের বা হিন্দুত্বের বিরোধী; কারণ ভারতীয়ত্ব বা হিন্দুত্ব ইঁহাদের চোখে ‘কুফর্’ বা বিধর্মিত্ব এবং ‘শিরক্’ বা বহু দেব-বাদিত্বেরই নামান্তর। হিন্দু বা ভারতীয় মাটিতে জন্ম— এই কথাতেই যেন কুফর্ ও শিরক্-এর আমেজ লাগিয়া আছে; তাই বহু ভারতীয় বা বাঙ্গালী মুসলমান নিজেকে সৈয়দ বা আরব, অথবা ঈরানী, পাঠান, মোগল বা তুর্কী বংশসম্ভূত বলিয়া পরিচয় দিতে পারিলে কৃতার্থ হয়। বাঙ্গালী বা ভারতীয় মুসলমানদের এই আত্মমর্য্যাদাবোধ-হীনতা তাহাদের পক্ষে— এবং আমাদের পক্ষেও বটে— এক হৃদয়বিদারক, সর্বনাশকর ট্রাজেডি। পারস্যের মুসলমানেরা কখনও এইভাবে আত্মমর্য্যাদা হারায় নাই; ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে পারসীকেরা নিজ জাতির আভিজাত্য, তাহার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলিতে চাহে নাই— বরং তাহাদের ‘শাহনামা’ গ্রন্থে, মুসলমান-পূর্ব যুগের পুরাণ-কথাকে তাহারা প্রাণপণে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। তুর্কী মুসলমানেরা তিন চার শতকের বিস্মৃতির পরে, আবার নূতন করিয়া তাহাদের জাতির গৌরব-কথা ফিরিয়া পাইবার চেষ্টা করিতেছে— তুর্কীরা এখন আরব ও ঈরানী প্রভাব হইতে নিজেদের মুক্ত করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে।
বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে মুসলমান উপাদান যেটুকু আসিয়াছে, এ-তাবৎ তাহা বাঙ্গালীর জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্য রাখিয়াই আসিয়াছে। এখন কোনও-কোনও দিক্ হইতে যে নবীন প্রয়াস হইতেছে, তদ্বারা ভাঙ্গন ঘটিবে— তাহার দ্বারা বড়ো একটা কিছু গড়িয়া উঠিবার কোনও লক্ষণ দেখা যাইতেছে বলিয়া মনে হয় না। বাঙ্গালী মুসলমানের প্রকৃতি এবং ইসলামধর্মী অন্যান্য জাতির মনের ও সভ্যতার প্রকৃতি ভালো করিয়া না বুঝিয়া, বাঙ্গালী মুসলমানের মনকে চালিত করিবার চেষ্টা করিলে, একটা কিম্ভূতকিমাকার বস্তুই সৃষ্ট হইবে, সত্যকার জাতীয় সংস্কৃতির সৃষ্টি হইবে না।
(ক্রমশ)