ধ্বংসের পথে ব্যাঙ্কশিল্প

কেন্দ্রের মোদী সরকার কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশের আর্থিক বুনিয়াদের অন্যতম ভিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শিল্পকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের দিকে কোপ পড়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি তো হবেই, একই সঙ্গে এই ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক-কমর্চারীর নিশ্চিত জীবিকাতেও চূড়ান্ত সঙ্কট নেমে আসবে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা ইতিমধ্যে মোদী সরকারের কর্পোরেট স্বার্থের নীতির ফলে নিদারুণ সঙ্কটের সম্মুখীন।

দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের স্বার্থে ও দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করে তার প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিল ভারত সরকার। দেশ ও দেশবাসীর কাছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া এই ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মোদী সরকারের কর্পোরেট স্বার্থের নীতি। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ, বেসরকারিকরণ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গচ্ছিত অর্থ ভাণ্ডারে থাবা বসানোর মতো নানা অভিসন্ধির মধ্য দিয়ে সরকারি ব্যাঙ্কব্যবস্থাকে এক শোচনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শিল্পে মুনাফা যথেষ্ট সন্তোষজনক। আরবিআই-এর দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশের সমস্ত সিডিউল ব্যাঙ্কগুলির আমানতের পরিমাণ লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে, মোদী সরকারের জমানায় শিল্পপতি তথা ঋণখেলাপীদের সরকারি আনুকূল্যে ঋণ মকুব, হেয়ারকাট ইত্যাদির নামে জলের দরে সংস্থাগুলি বেচে দেওয়া, অনেক ক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ মকুব করে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের নয়ছয় করা হচ্ছে।

প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব মানুষের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দিতে সত্তরের দশকে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। এর ৪০-৪২ বছর পর মনমোহন সিংয়ের জমানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ছিল ২৭টি। কিন্তু গোটা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকেই বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার যে নীতি নিয়েছে মোদী সরকার, তার জেরে এখন সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২টিতে। একটির সঙ্গে আরেকটিকে যুক্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে ৪ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে আগাম জানিয়ে রেখেছে মোদী সরকার। এই সংযুক্তিকরণের ফলে ব্যাঙ্ক ও তার শাখা যেমন কমেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে কর্মী সংখ্যাও। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মিলিত কর্মীসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ। দশ বছরে তা দেড় লক্ষ কমে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে করণিকের সংখ্যা। এটা মুদ্রার একদিক। অন্যদিকে এইসময়কালে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে কর্মীর সংখ্যা ৩ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ। বলাই বাাহুল্য, এইসব ব্যাঙ্কের সংখ্যাও বেড়েছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সরকারি ক্ষেত্রকে গল টিপে হত্যা করে বেসরকারি ক্ষেত্রকে উৎসাহ দেওয়া।


দশ বছর আগে বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তারপর দু’দফায় মোট দশ বছরের শাসনকালে তাঁর সরকারের অবদান হল, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে দশ লক্ষ শূন্যপদ তৈরি। পাশাপাশি বেকারত্বের হারে গত ৪৫ বছরে রেকর্ড করে ফেলা। এই বেকারদের ৮০ শতাংশই যুবক-যুবতী। এঁদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হার ২০০০ সালে ছিল ৩৫.২ শতাংশ, যা মোদী সরকারের নৈপুণ্যে ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫.৭ শতাংশে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ সালের তুলনায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ।

তীব্র বেকারত্বের ভয়াবহ ছবির পাশাপাশি চলছে দেদার কর্মী সংকোচন। গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মী সংকোচন করেছে কেন্দ্র। দেশের প্রথম সারির ১৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে ১২টিতে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কর্মী সংখ্যা কমানো হয়েছে। কোল ইন্ডিয়া, স্টেট ব্যাঙ্ক, ‘হ্যাল’ সহ ১২টি সংস্থায় মাত্র এক বছরে কর্মী সংখ্যা কমেছে ২৪ হাজারেরও বেশি। একই ছবি ধরা পড়েছে ব্যাঙ্ক থেকে খনি সর্বত্র।

সকলের জন্য শিক্ষা, শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, আর সেই চাকরি সংবিধান অনুযায়ী সুনিশ্চিত করা— মোদীরাজ্যে এই তিন জরুরী বিষয় এখন ভুলতে বসেছে দেশের যুব সমাজ। বেকারত্ব, কর্মী সংকোচন ও শূন্যপদের ত্র্যহস্পর্শে এখন জেরবার যুবসমাজ। প্রধানমন্ত্রী কিংবা শাসক গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতারা এই জ্বলন্ত ও ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না।
মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর উদাহরণ এর চেয়ে ভালো আর হতে পারে না। এটাই মোদীর ‘গ্যারান্টি’।