শোভনলাল চক্রবর্তী
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তারি এবং আদালতে তাঁর জামিন আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়া ঘিরে বাংলাদেশ আবার তোলপাড়। অরাজক অবস্থা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতি। শুরু হয়েছে যাকে বলে মাৎস্যন্যায়। যে যা খুশি করে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই বলার কেউ নেই। ভারতে আবার দেখতে পাচ্ছি অনেকে বলছেন এই শাসনের নাম নাকি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। ঢাকাই কুট্টি জীবিত আছেন না অগাষ্ট মাসের দুনিয়া কাঁপানো কুড়ি দিনে প্রাণ দিয়েছেন জানি না। জীবিত থাকলে তাঁর ঘোড়াটি জোরে জোরে হাসত।
শাসকের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক ভাবে তার মোকাবিলা কাঙ্ক্ষিত। তা না করে শাসকের অনুপস্থিতিতে তাঁর প্রাসাদে ঢুকে পড়ে লুটতরাজ, নিরীহ সংখ্যালঘুদের ব্যবসাক্ষেত্রে, কি প্রার্থনাস্থলে অগ্নিসংযোগ, বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করে ঝুলিয়ে দেওয়া, সভ্য মানুষের এমন আচরণকে যাঁরা বিপ্লব বলেন তাঁদের কি রকম দেখতে বড় জানতে ইচ্ছে করে। শাসকের উপর ক্ষোভ ফলাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— জাতির জন্মলাভে অবিসংবাদিত ভূমিকা ছিল বলে ‘জাতির পিতা’ হিসাবে মান্য করা হয় যাঁকে— তাঁর মূর্তির মাথায় পা রেখে পতাকা দোলানো হল। বঙ্গবন্ধুর মূর্তির গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে তাকে ধূলিসাৎ করে ফেলা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ সব কোন চেতনার পরিচয় বহন করে?
অনেকে বলছেন শেখ হাসিনার গণতন্ত্র লঙ্ঘন ও জবরদস্তিমূলক শাসনের জন্য আজ বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, চিন ও পাকিস্তানের মদতের জন্য ভারতবন্ধু শেখ হাসিনাকে সরতে হল। ঘটনা যা-ই হোক, বিরোধীদের সম্মান করা, তাঁদের পরামর্শ মেনে দেশ চালানো, এটাই গণতন্ত্রের মূল আদর্শ। যারা সেটা মানবে না, তারা গণতন্ত্রকে অপমান করছে। ১৫ অগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছিল সে দেশের সেনাবাহিনী। ৫ অগস্ট, ২০২৪-এ বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা যদি বাংলাদেশ ত্যাগ না করতেন, তা হলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারত। ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার উপর বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তার কারণ, পর পর তিনটি সাধারণ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল হাসিনা সরকার। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, শেখ হাসিনার একনায়ক-সুলভ আচরণ তাঁকে ও তাঁর দলকে মানুষের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করছিল। সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপরে নির্বিচারে গুলিচালনা ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। পরবর্তী কয়েক দিনে বাংলাদেশের রাজপথ মৌলবাদীদের ও ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায়। যে কোনও গণআন্দোলনে যদি সঠিক দিশা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব না থাকে, তবে তা নৈরাজ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার উদাহরণ।
মূর্তি উৎপাটন, মুরাল ধ্বংস দিয়ে শুরু, অতঃপর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাসগৃহ তথা সংগ্রহশালায় আগুন। যা ছিল উগ্র ক্রুদ্ধ জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে তা সরকারি ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্মৃতি নির্মূল প্রকল্প’ হয়ে উঠেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর ও তাঁর পরিবারের অনুষঙ্গ জড়িত কয়েকটি জাতীয় দিবস বাতিল ঘোষণার পর সম্প্রতি সেখানকার রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বই থেকে বাদ পড়ছে বঙ্গবন্ধুর লেখা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা তার এক প্রকার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সমাজমাধ্যমে, বঙ্গবন্ধু সেখানে শুধুই ‘১৯৭১-পরবর্তী ফ্যাসিবাদী নেতা’।রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আবহে প্রকৃত ইতিহাস ও ইতিহাস-নির্মাতাদের মুছে দেওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, বিশ্ব জুড়েই নানা দেশে নানা কালে এই চেষ্টা হয়েছে, তাতে কাজের কাজটি হয়নি। স্রেফ মূর্তি ভেঙে, ছবি সরিয়ে, এমনকি পাঠ্যপুস্তকে বদল এনেও যে জনস্মৃতি থেকে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া যায় না, স্বাধীনতার কান্ডারি ও কারিগরদের মুছে ফেলা যায় না, সেও ইতিহাসেরই শিক্ষা।
মিলান কুন্দেরার বহুশ্রুত বাক্যটি আবারও স্মরণ করতে হয়: ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। মূর্তি, সড়ক, প্রতিষ্ঠান, ছবি, বই, অতীত ইতিহাসের স্মারক যা কিছু জনপরিসরে দৃশ্যমান, নতুন জমানার ক্ষমতা তা ভুলিয়ে দিতে চাইবে, চেষ্টা করবে অতীতের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিপরীতে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্ত হিসাবে ২০২৪-এর জুলাই-অগস্টকে তুলে ধরা তারই উদাহরণ, আগের সরকারের সংবিধান সংশোধনীকে কাঠগড়ায় তুলে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ও তার ধারণাকেও মুছে ফেলার প্রস্তাব তারই পরের ধাপ। জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালিকে মুক্তির পথে একত্র ও স্থিরলক্ষ্য করলেন যিনি, তাঁর বিচার করতে হচ্ছে উত্তরসূরির একতন্ত্রের অপরাধে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান সম্পর্কে কুলুপ এঁটে, এ-ই কি সবচেয়ে বড় প্রমাণ নয়— ইতিহাসে তাঁর ভূমিকাটি নির্বিকল্প, অপরিবর্তনীয়?
শাসনতন্ত্র যখন ক্ষমতাতন্ত্র হয়ে ওঠে তখনই এই নতুন ইতিহাস লেখার, পুরনো ইতিহাসকে বর্জনের প্রবণতা বাড়ে। রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে উত্তেজিত, বিভ্রান্ত, ক্লান্ত নাগরিকদের ঢাল করে আখের গোছাতে চায় ক্ষমতালিপ্সু অপশক্তি। এই রকম অস্থির সময়ই সচেতন ও সুচেতন নাগরিকদের পরীক্ষা— অর্জিত ইতিহাসের মাটিতে নিজেদের শিকড় এখনও দৃঢ় প্রোথিত আছে কি না তা দেখে নেওয়ার, কিছুমাত্র ধস দেখলে অবিলম্বে তা সংস্কারের। এই সংস্কার কাজটি দ্বিমুখী। রাজনৈতিক অপশক্তি যখনই স্বার্থসিদ্ধির মতলবে স্বদেশের প্রকৃত ইতিহাস ও স্বাধীনতার রূপকারদের মর্যাদাহানি করবে, সর্বাবস্থায় সর্বশক্তিতে তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে বহিরঙ্গে এবং স্বদেশের ইতিহাস ও ইতিহাস-রচয়িতাদের জাগরূক রাখতে হবে অন্তর্জীবনে— স্মৃতিতে ও যাপনে। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে আসল ইতিহাস, যাতে তারা রাজনীতি ও ক্ষমতাতন্ত্রের ক্রীড়নক হয়ে না ওঠে।
জনস্মৃতির মহামূল্য মহাফেজখানাতেই ইতিহাসের আশ্রয়, তাকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না কোনও মূল্যেই। বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চরমপন্থার বাড়বাড়ন্ত এবং সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন নিয়ে ফের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিবির। প্রথম দফায় দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তা লিসা কার্টিস মন্তব্য করেছেন, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের ফলে বাংলাদেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করবে’। চরমপন্থী, মৌলবাদী এবং জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনা ‘প্রশংসনীয়’ দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলেও সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন কার্টিস। বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার বাইডেন সরকার এবং ট্রাম্পের মধ্যে গুরুতর মতভেদের বিষয়টি আগেও সামনে এসেছে। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, বাইডেন প্রশাসনই গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। হাসিনার দাবি অনুযায়ী— সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে দিতে রাজি না-হওয়াতেই বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু পরিকল্পনা করে তাঁকে উচ্ছেদ করেছেন। ঢাকায় নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সখ্য যথেষ্ট। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অব্যবহিত আগে দেওয়ালির শুভেচ্ছা বার্তায় ট্রাম্প বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে হত্যা ও নির্যাতন’-এর উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারপরে এই পরিস্থিতির জন্য তিনি বাইডেনকে দায়ী করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, কারণ তাঁদের মতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য বাইডেনকে দায়ী করে তিনি ঢাকায় শাসক পরিবর্তনের নীতির সমালোচনাই করেছেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ট হিসাবে পরিচিত লিসা কার্টিস এ দিন বলেন, “বলা হয়েছিল শেখ হাসিনার উৎখাতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বেশ কিছু জঙ্গি নেতাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।” ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া সংক্রান্ত ডিরেক্টরের দায়িত্বে থাকা কার্টিস বলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ইতিহাস আছে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলা ভয়ঙ্কর ঘটনা। এ দেশে আইএস প্রভাবিত কিছু শক্তি রয়েছে। হাসিনা জঙ্গি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। রাজনীতির ময়দানে এই শক্তির ফিরে আসার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের।”
কার্টিসের কথায়, এই ঘটনা কারও পক্ষেই ভাল হতে পারে না। তিনি বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। যদিও এটা অগ্রাধিকারের প্রথম স্থানে নেই, তবু ভাবী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দল বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে।” অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কাজকর্ম নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ব্রাসেলসের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। তাতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। তাদের উচ্ছেদের পরে ইউনূস সরকারের উপরে দেশের মানুষের অগাধ প্রত্যাশার চাপ। তবে রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের মতো ক্ষেত্রে সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, নতুন সরকারের পক্ষে এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করা খুবই কঠিন। এ দিনই সরকার সমর্থক বৃহত্তম দল বিএনপির একটি দল ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মেগান বোল্ডিনের সঙ্গে দেখা করেন। ট্রাম্প সরকারের আস্থা অর্জনের জন্যই তাদের এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু দেশে শাসন জারি না হলে এসবে কাজ হবে না।