• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 October, 2024

‘দেশ মেরামত’ যে কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে এমন কোনও ছবি যেন তাদের কাছে না-পৌঁছয়, যাতে সরকারের মুখ পোড়ে। ৫ অগস্ট আগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছিল।

পেশাসূত্রে নানা ঝামেলা-ঝক্কির মোকাবিলা সংবাদকর্মীরা করে থাকেন। কিন্তু সংবাদজীবী হওয়ার কারণে যদি প্রাণটি বেঘোরে যেতে বসার উপক্রম হয়, তখন বুঝতে হবে আসল সমস্যা অন্য ও অন্যত্র। শেখ হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশে অগণিত সংবাদকর্মী এখন সেই সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় দেড়শো জন সাংবাদিক-সম্পাদক রাতারাতি হয়ে দাঁড়িয়েছেন ‘অপরাধী’: খুন, গণহত্যা, মাদক চোরাচালান, মানবতাবিরোধী নানা গুরুতর অপরাধে চিহ্নিত ও অভিযুক্ত। বাংলাদেশের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং এডিটরস’ গিল্ডের সভাপতি গ্রেফতার হয়ে পুলিশি হেফাজতে, এখন জানা যাচ্ছে যে ঢাকার বহু সিনিয়র সাংবাদিক গ্রেফতারি এড়াতে আত্মগোপন করে আছেন। এই সবই অতি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশের ঘটনাক্রম দেখে উদ্বেগ বোধ না করে পারা যায় না, কারণ সাংবাদিকের স্বাধীনতার স্বীকৃতি শুধু সংবাদমাধ্যমের সুস্থতার জন্য জরুরি নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক সুস্থতার জন্যই প্রয়োজন। বিশেষত যদি সে দেশ গণতন্ত্রের কথা বলে। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সাম্প্রতিক কালে বারংবার বিঘ্নিত ও লঙ্ঘিত, ভারতীয় নাগরিকমাত্রেই জানেন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে এই অঞ্চল এখন কতখানি নীচের দিকে। শাসকের সঙ্গে যুঝে কাজ করা উপমহাদেশের সংবাদকর্মীদের জন্য নতুন বিষয় নয়। তবুও সাম্প্রতিক বাংলাদেশে তাঁদের দমন-পীড়নের সীমা আতঙ্ক জাগাচ্ছে কারণ সেখানে সংবাদকর্মীদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাক্তন শাসকের রাজনৈতিক অপরাধের দোসর হিসাবে। তারই খেসারত পুলিশি হেনস্থা, গ্রেফতার; গুরুতর মামলার আসামি-তালিকায় তাঁদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে গণহত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, প্ররোচক হিসাবে। ভাঙচুর হয়েছে খবরকাগজ ও টিভি চ্যানেল দফতর, ‘দখল’ করা হচ্ছে প্রেস ক্লাব।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ গভীর উদ্বেগে অন্তর্বর্তিকালীন সরকারকে বলেছে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বৈধ ভিসা নিয়ে তিনি সপরিবার ভিন্‌ দেশে যেতে আখাউড়ার চেকপোস্টে উপস্থিত হলেও আটকে দেওয়া হয়েছিল শ্যামল দত্তকে। এর পরে শ্যামল ঢাকা থেকে বিমানে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন। বিমানবন্দরেও তাঁকে আটকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে এই শ্যামল দত্ত এবং বাংলাদেশের এডিটর্স গিল্ড-এর সভাপতি মোজাম্মেল বাবুকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাবুও বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী চ্যানেল ‘একাত্তর টেলিভিশন’-এর সম্পাদক। পুলিশের দাবি, তাঁরা অবৈধ ভাবে দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্যে সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময়ে স্থানীয় লোকেরা তাঁদের গাড়ি আটকে থানার হাতে তুলে দিয়েছে।বাংলাদেশের এই দুই প্রথম সারির সাংবাদিক-সম্পাদক এখন খুনের মামলার আসামি।

দু’টি মৃত্যুর ঘটনার দু’টি পৃথক মামলায় পুলিশ বহু অভিযুক্তের সঙ্গে শ্যামল দত্ত এবং মোজাম্মেল বাবুর নামও ঢুকিয়েছে। সেই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এই দু’জনকে। ঠিক যেমন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নুর, যাঁকে গভীর রাতে তাঁর নিজের ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর ঘটনায় এক ঝাঁক অভিযুক্তের সঙ্গে প্রবীণ এই শিল্পীর নামও জুড়েছে পুলিশ, যে মামলায় আজ আদালত তাঁকে ও সাবেক বিমানমন্ত্রী মাহবুব আলিকে জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে। অভিনেতা নুর ইউনূস সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়ার কারণ, ২০১৪ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সংস্কৃতিমন্ত্রী করেছিলেন।

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরেই মোজাম্মেল বাবুর ‘একাত্তর টিভি’-র দফতর ভেঙে চুরমার করে দেয় গণঅভ্যুত্থানের সশস্ত্র সমর্থকেরা। তার পরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর এক দল লোক এই চ্যানেলটি দখল করে দলীয় সাংবাদিকদের কাজে বসায়। একই ভাবে দখল করা হয়েছে ‘নিউজ ২৪’, ‘সময় টিভি’ এবং ‘মাই টিভি’। ‘কালের কণ্ঠ’ ও ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-সহ ৫টি জাতীয় পত্রিকা এবং অন্তত ২৫টি আঞ্চলিক পত্রিকার দফতরও দখল করা হয়েছে। ঢাকার প্রায় ১৫৫ এবং চট্টগ্রামের ২৮ জন সাংবাদিককে খুন, গণহত্যা, মাদক চোরাচালান-সহ বিভিন্ন গুরুতর মামলার আসামির তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এডিটর্স গিল্ড-এর বিবৃতি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে অজস্র স্থানীয় সাংবাদিককে হেনস্থার উদ্দেশ্যে মামলা দিয়েছে ইউনূস সরকারের পুলিশ। নির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদককে তাড়িয়ে দিয়ে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাব দখল করেছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক সাংবাদিকেরা। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব দখলের জন্য তিন বার হামলা চালানো হয়। ব্যাপক ভাঙচুর করেও বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকেরা ক্লাবের দখল নিতে পারেনি। কিন্তু এই হামলায় অন্তত ২০ জন সাংবাদিক আহত হন। সেনা এসে আটকে পড়া ও জখম সাংবাদিকদের উদ্ধার করে। একই ভাবে নির্বাচিত কমিটিকে মেরে বার করে দিয়ে মফস্সলের অন্তত ১২টি প্রেস ক্লাব দখল করা হয়েছে।প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য— সংবাদমাধ্যম স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারছে। তারা সরকারের যত খুশি সমালোচনা করতে পারছে।” ওদিকে ঢাকার এক দল সিনিয়র সাংবাদিক এখন পুলিশের দেওয়া মনগড়া মামলায় গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন।

বাকিরা ইউনূসের কথা শুনে খুব হাসছেন, কিন্তু শব্দ না-করে। কারণ শব্দ বাইরে গেলেই খুনের মামলা জুটে যেতে পারে। মিথ্যা মামলায় হেনস্থা হওয়ার জন্য কে এই সরকারের সমালোচনা করতে যাবে? এমনই মত ঢাকার এক বিশিষ্ট সাংবাদিকের, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যিনি বরাবর থেকেছেন সামনের সারিতে। তথাকথিত বিপ্লব উত্তর ঘটনাবলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংবাদকর্মীরা এখানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির রাজনৈতিক শিকার। অন্তর্বর্তী সরকার এখন যে দেশ মেরামতের কথা বলছে, সাংবাদিক-নিপীড়নের চিত্রটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত বাস্তবের। সাংবাদিকদের নামে খুনের মামলা দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের পুলিশ— নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশে এ দুঃস্বপ্নের শামিল। আবার অপ্রিয় হলেও এই সত্যটি না বলে উপায় নেই, প্রেস ক্লাব দখল থেকে দফতর ভাঙচুরে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় হিসাবে উঠে আসছে বিএনপি ও বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর নাম। অর্থাৎ আগের জমানার শাসক ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাই লক্ষ্য, সংবাদকর্মীরা তারই ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।

দশ বছর আগের সংস্কৃতিমন্ত্রী বা মৌলবাদ-বিরোধিতায় সতত সরব বুদ্ধিজীবীও যেখানে গ্রেফতারি থেকে ছাড় পান না, সংবাদকর্মীদের দশা সেখানে সহজে অনুমেয়। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুকালীন পরিচয়, তবুও সাংবাদিকের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে যে পরিস্থিতি সে দেশে সম্প্রতি উদ্ভূত হয়েছে, তাতে উপমহাদেশীয় নাগরিক হিসাবে গভীর উদ্বিগ্ন, বিপন্ন হতে হয়।বাংলাদেশে সেনাদের হাতে গ্রেফতার ও জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করছেন অনেকে। কারও কারও আবার ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকারকে সরিয়ে বাংলাদেশে পুরোদস্তুর সেনাশাসন কায়েমের পথে এটা প্রথম ধাপ। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, গোটা দেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতেই সর্বত্র মোতায়েন সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মাত্র দু’মাসের জন্য যে সেনারা এই ক্ষমতা ভোগ করবে, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কোটা-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ।রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখার একটি দল এখন বাংলাদেশে ঘুরে ঘুরে বিক্ষোভ দমনে আগের সরকারের বলপ্রয়োগ, মানবাধিকার ভঙ্গ এবং প্রাণহানির ঘটনাগুলি খতিয়ে দেখছে।

অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে এমন কোনও ছবি যেন তাদের কাছে না-পৌঁছয়, যাতে সরকারের মুখ পোড়ে। ৫ অগস্ট আগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছিল। থানা পুলিশের অনুপস্থিতিতে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি চরমে পৌঁছেছিল। সেই পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও দল বেঁধে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা করা, ধর্মস্থান আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটছে। এগুলোকে সরকার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে গুরুত্ব না দিলেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে পশ্চিমি সরকার ও গণমাধ্যমেও। অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রী ক্রিস বোয়েন কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কানাডার এক এমপি-ও একই ভাবে উদ্বেগ জানিয়ে সংসদ ভবনের বাইরে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন। পশ্চিমি কিছু মানবাধিকার সংগঠনও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন নিয়ে সরব হয়েছে। কেউ কেউ রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরে চিঠিও দিয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপঞ্জের বৈঠকে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে আছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় থাকা দলটির কাছে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাইছে সরকার।

পাশাপাশি দেশের প্রায় সর্বত্র সুফি মাজার ও বাউল সম্প্রদায়ের উপরে হামলার ঘটনা ঘটছে। মাদ্রাসা ছাত্রদের নেতৃত্বে রোজই প্রায় ভাঙা হচ্ছে চার-পাঁচশো বছর ধরে টিকে থাকা এই মাজারগুলি। ইসলাম-বিরোধী আখ্যা দিয়ে সেখানে গান-বাজনা বন্ধ করা হচ্ছে। সরকার এই সব বিষয়ে রাশ টানতে ব্যর্থ। সূত্রের খবর, সেনারাও এই সব নিয়ে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতায় রুষ্ট হয়ে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ‘দখল করল’। এর পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হলে বাংলাদেশের শাসনভার পুরোটা তুলে নিতেও যে তারা তৈরি, সেই বার্তাই দিচ্ছে সেনাবাহিনী।