বাংলাদেশ কি একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে?

ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বলি দিয়ে বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হবে কিনা, তা নিয়ে জামায়েতে ইসলামীর নেতারা উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের বড় শরিক বিএনপি’র নেতাদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে শলাপরামর্শ চলেছে। ইসলামিক রাষ্ট্র হলে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনে সরকার চলবে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম— অন্য কোনও ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ নেই। আবার জাতীয় সরকার গঠনের কথাও বলা হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশ যে কোন পথে হাঁটবে, তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। যদি বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের নিজনিজ ধর্ম পালনের অধিকার থাকবে কিনা বা তাদের জীবন সুরক্ষিত হবে কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমশয়। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল, তখন সে দেশের লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি— গত ৫৩ বছরে সেই লোকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ থেকে ১৭ কোটি। আর হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সংখ্যা আনুমানিক দেড় থেকে দুই কোটি।

ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করছেন সে দেশের কট্টর মৌলবাদীরা তাদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। তারা জামায়েত ইসলামী দলের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে। বাংলাদেশ যে পথেই হাঁটুক না কেন, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা বা ধর্ম পালন একটি কঠিন স্তরেই থাকবে। মাঝে মাঝেই হয়তো তাদের কট্টর মৌলবাদীদের রোষে পড়তে হবে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজাপার্বন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবেই। জামায়েতেরা তদারকি সরকারের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসের কাছে সম্প্রতি আবেদন রেখেছেন দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষের জায়গায় ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে। যদি বাংলাদেশ সত্যিই একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাহলে সংখ্যালঘুদের সর্বদাই শঙ্কিত হয়ে থাকতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও, এখন যে সংখ্যালঘুরা সুখে ও শান্তির সঙ্গে জীবনযাপন করছে, তা বলা যাবে না। গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশে কোনও না কোনও সময়, বিশেষ করে দুর্গাপুজোর সময় তাদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে।

দেশের অনেক অঞ্চলেই মন্দির অপবিত্র করা, মূর্ত্তি ভাঙা এবং হিন্দুদের ওপর অত্যাচার সহ পুজোপার্বন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এই পাঁচ দশকের বেশির ভাগ সময়েই আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। বছর তিনেক আগে পুজোর সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন সময় গণ্ডগোল হওয়াতে নির্বিঘ্নে পুজো হয় না, তা নিয়ে ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং হাসিনা সরকারকে সংখ্যালঘুদের জীবনযাপন এবং পুজো করার অধিকার যাতে খর্ব না হয়, তার জন্য আর্জি জানিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই যখন এই অবস্থা, তখন ইসলামিক রাষ্ট্র হলে যে কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।


চার মাস আগে বাংলাদেশে যে গণ অভ্যুত্থান হচ্ছে তার মূলে ছিল কট্টর মৌলবাদী ও তালিবানিপন্থীরা। বিএনপি সমর্থকদের একাংশ তাদের সঙ্গে ছিল। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও কট্টর ছাত্রদের সংগঠন। এরা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সুসম্পর্ক এবং সেই দেশের উন্নয়নে ভারতের সাহায্য ও নানা বিষয়ে সহযোগিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। অনেকদিন থেকেই এরা সুযোগ খুঁজছিল কী করে আওয়ামি লিগ সরকারের পতন ঘটানো যায়। বাংলাদেশের সেনারা মৌলবাদী, পাকিস্তানপন্থী এবং হাসিনা সরকারের বিরোধী। ছাত্রদের সারা বাংলাদেশ ব্যাপী ধ্বংসলীলা থামাতে তেমন একটি অগ্রণী ভূমিকা নিতেপারেনি। যার ফলে এ দেশের প্রভূত সম্পত্তির ধ্বংস হয়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বাসস্থান গণভবন বিক্ষোভকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র লুঠ হয়ে যায়। হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে গণভবন থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং বাংলাদেশেরই একটি প্লেন তাঁকে দিল্লিতে পৌঁছে দেয়। তিনি এখন দিল্লিতেই অবস্থান করছেন। ভারত সরকার তাঁকে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, এই তদারকি সরকার কতদিন চলবে? বিএনপি এবং কট্টর মৌলবাদীরা বাংলাদেশে আশু সাধারণ নির্বাচন চাইছে, যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে সেই সরকার দেশের সংস্কার করে বর্তমান সংবিধানের সংশোধন করবে। সংশোধনে প্রধান বিষয় যা অন্তর্ভুক্তি করতে হবে, তা হল বাংলাদেশ হবে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র এবং ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনে সরকার চলবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কথাটি সংবিধান থেকে বাদ পড়বে। মৌলবাদীদের একংশ চাইছে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করা। বিএনপি যদিও এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানায়নি।

বাংলাদেশের সেনা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মহম্মদ ইউনূসকে বিদেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয়। তিনি তদারকি সরকার গঠন করেন। বলে দেওয়া হয়েছিল, এই ইউনূস সরকার বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হয়েছে কিন্তু নির্বাচনের কোনও ব্যবস্থা কমিশন করতে পারছে না বর্তমানে বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতির জন্য। বর্তমান রাষ্ট্রপতি বলতে গেলে তাঁর আবাসে বন্দি। কিন্তু ইউনূসের সরকার দেশের অরাজকতা দূর এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করে নির্বাচনের পথ সুগম করতে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই বাংলাদেশে শান্তিশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। সংখ্যালঘুরা বিপন্ন। বেশ কয়েকটি জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর চরম অত্যাচার চলছে। তাদের বাড়িঘর অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মন্দির ধ্বংস করা হচ্ছে— মন্দিরের মূর্ত্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ নির্বিকার। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি, টাকাপয়সা এবং সোনার অলঙ্কারাদি লুঠ করা হচ্ছে অবলীলায়। কোনও বাধাবিপত্তি সরকারের তরফে দেওয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের জীবনমান রক্ষা করার কোনও পদক্ষেপ বর্তমান তদারকি সরকার নিতে পারছে না। ফলে সারা বাংলাদেশে একটি অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইসকনের অন্যতম প্রধান সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম দায়রা আদালতে তাঁর হয়ে সওয়াল করার জন্য কোনও আইনজীবী না দাঁড়ানোর ফলে বিচারক তাঁর জামিন না দিয়ে আরও একমাস তাঁকে জেলবন্দি রাখার রায় দিয়েছেন। এই সন্ন্যাসীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদের ঢেউ পশ্চিমবঙ্গ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসে পড়েছে। সর্বত্রই তাঁর আশু মুক্তির দাবি উঠেছে। এই সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক, কবি, সাহিত্যিকরা সমর্থন করেননি। ইউনূস সরকারের এই কাজটি অত্যন্ত গর্হিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে তো শান্তি আনতে পারলেনই না, উল্টে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের জন্য তিনি সব4ত্র ধিকৃত ও নিন্দিত হচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, ইউনূসের এটা একটা বড় ভুল। ভারত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, পীড়ন বন্ধ করার আর্জি জানিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী দুই দেশের সুসম্পর্ককে বিষিয়ে তুলেছে। এই তদারকি সরকারের কার্যকলাপ মেনে নিতে পারছেন না বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকরাও। তাঁদের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, যা বিশ্বের সব দেশেই তারিফ করে।

কিন্তু যে প্রশ্ন সবাইকে নাড়া দিচ্ছে, তা হল বাংলাদেশ যদি সত্যিই একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে প্রায় দুই কোটি সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রা রক্ষা এবং ধর্মীয় অধিকার থাকবে তো? না তালিবানী শাসনের মতো এই দেশেও সর্বশ্রেণির সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার খর্ব করা হবে? হিন্দুদের ধর্মাচরণে বাধা পড়বে। কারণ ইতিমধ্যেই একটা ঘটনা মানুষের মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা হল গোপালগঞ্জে, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের— সেখানে একটি স্থানে মৌলবাদীরা মাইকে প্রচার শুরু করে দিয়েছে যে এখন থেকে কোনও মহিলা জিনিসপত্র কিনতে বাজারে ঢুকতে পারবে না। যদি এই নির্দেশ অমান্য করে কোনও মহিলা বাজারে আসে, তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানেও যদি অনুরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে তো তা তালিবানী শাসনে যা হচ্ছে, এখানেও তাই হবে। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে তদারকি সরকারের কোনও মন্তব্য শোনা যায়নি। তদারকি সরকারের অনুরাগী ইতিমধ্যেই চিনের একদল প্রতিনিধি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আালোচনা করেন। আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশে যে কোনও পরিস্থিতিই হোক বেজিং সবসময়ই এই দেশের পাশে থাকবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। পাকিস্তান দূতাবাসের হাই কমিশনারও খালেদার সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের বিশেষ আগ্রহ রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এদেশে তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নেও সাহায্য করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল চিন বাংলাদেশকে সমরাস্ত্র দিয়েও সাহায্য করেছে। চিনের বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ এবং এই দেশে তার আধিপত্য বিস্তার করাকে ভারত ভালোভাবে নিচ্ছে না। কারণ চিন বাংলাদেশে এসে খবরদারি করলে, ভারতের কাছে তা অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু পাকিস্তান খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলাতে। যদিও বাংলাদেশের মৌলবাদীদের একাংশ চায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তিকরণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই কিছু পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশের নাগরিক সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর এই যোগাযোগ আরও নিবিড় হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশ চিনের আধিপত্য মেনে নিলে, ভারতের কাছে তা হজম করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এবং ভারত কখনও তা খোলা মনে নেবে না। আবার সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের (যে সরকার নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠিত হবে) ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া চলা অত্যন্ত কঠিন। কারণ বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষেত্রে ভারত সবসময়ই সাহায্য করে আসছে। সাহায্যকরে আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নেও। বাংলাদেশের সঙ্গে চিনের মাখামাখি ভারত কোনওবাবেই মেনে নেবে না। আর ভারতের সঙ্গে বৈরতা সৃষ্টিকরেও বাংলাদেশ চলতে পারবে না। সুতরাং চিন এবং পাকিস্তান বাংলআদেশে যতই সক্রিয় হোক, বাংলাদেশ ভারত বিরোধিতার পথে চললে, বাংলাদেশেরই ক্ষতি হবে। অদূর ভবিষ্যতে যে সরকারই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, তাদের বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে তুললে চলবে না।