নারায়ণ দাস
ভারতের নিকটতম বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশে কি শান্তি ফিরে আসবে না? জনজীবন ভয়ভীতিশূন্য, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্বাভাবিক পড়াশুনার বাতাবরণ দেখা যাবে না? উন্নয়নের চাকা ঘুরবে না? এই তিনটি প্রশ্নের মধ্যে এখন কোনওটারই প্রকৃত উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ বাংলাদেশে এখন মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার চলছে, এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেবার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি এখনও। রাজনৈতিক দলগুলি এই তদারকি সরকার বেশিদিন থাকুক এবং দেশ বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমে পিছিয়ে পড়বে, তা চায় না। বাংলাদেশের বয়স তো কম হল না— সেই নিরিখে উন্নয়ন বলতে যা কিছু হয়েছে, তা আওয়ামি লিগ দলের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর আমলেই। সম্প্রতি কোটা বিরোধীরা যে আন্দোলন শুরু করে, তা দিন দিন বৃহৎ পর্যায়ে উপনীত হলে, সেনাবাহিনী তা থামাতে যে কঠিন পদক্ষেপ নেয়, তা শেষ পর্যন্ত গণ অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এই গণ অভ্যুত্থানে প্রচুর সংখ্যক মানুষের জীবনহানি হয়, দেশের প্রভূত সম্পত্তি ধ্বংস হয় এবং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা প্রাণনাশের ভয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে এসে আশ্রয় নেন। এখন তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন এবং ভারতেই থাকবেন একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। তারপর সেনা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি তদারকি সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল মনে করে তদারকি সরকারের প্রধান কাজ হল দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পুনরায় নির্বাচনের রাস্তা প্রস্তুত করে দেওয়া, সেটাই হবে এই তদারকি সরকারের প্রধান কাজ। কিন্তু অদ্যাবধি তদারকি সরকার সেই পথে হাঁটছে বলা যাবে না।
সম্প্রতি হঠাৎই আবার বাংলাদেশ অশান্ত হয়ে উঠল, যা অনেককে আবার উদ্বিগ্ন করল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা আবার পাঁচ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই দাবিগুলি কী কী? প্রধান দাবি, বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহাবুদ্দিন ঢুপ্পুর পদত্যাগ, আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগকে জঙ্গি তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ইত্যাদি। এই ছাত্র সংগঠন আবার নতুন করে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে— দেশের সব জেলা ও উপজেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনামা জারি করেছে। ছাত্র বিক্ষোভকারীরা ঢাকায় রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল বঙ্গ ভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের কাছে থাকলেও তাদের সরায়নি। কিন্তু একটু বেশি রাতের দিকে বিক্ষোভকারীরা বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেড ফাটায়। তাতে কাজ না হলে বেদম লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভকারী ছাত্রদের আরও একটা দাবি, আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই নানা বিষয় নিয়ে সরকারের পক্ষে আন্দোলন করছিল, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একচেটিয়া খবরদারি চালাচ্ছিল, সেই ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। তবে তদারকি সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, ছাত্র লিগের কর্মী বা কোনও সদস্য এখন থেকে কোনও সরকারি চাকরি পাবে না। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চাত্রলিগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ঝটিকা মিছিল করে, পুলিশ তাদের বেদম পিটিয়ে স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য করে। তদারকি সরকারের যুব কল্যাণ উপদেষ্টা ঘোষণা করেন, সরকারি পদে যেসব নিয়োগ তালিকা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে আওয়ামি লিগ কর্মীদের বাদ দেওয়া হবে। এখন থেকে এই দল এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠন সরকারি চাকরি পাবে না। ছাত্র লিগ এর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় মিটিং-মিছিল করছে এবং পুলিশ তদারকি সরকারের নির্দেশে তাদের বলপূর্বক হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও তারা দমে যায়নি— লুকিয়ে সভাসমিতি করছে।
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষীরা ছাত্রলিগের বহু সমর্থকের ওপর অত্যাচার চালায়। তাঁদের অনেককে হত্যা করে। পাশাপাশি, এই ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে খুন ও গণহত্যার মামলা করা হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাথ আবদুল্লা ঘোষণা করেছেন, আওয়ামি লিগের এই ছাত্র সংগঠনকে আর মাথা তুলতে দেওয়া হবে না। এর প্রতিবাদে ছাত্রলিগ দেশের নানা স্থানে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে, কিন্তু স্থানত্যাগ করতে বাধ্য করে পুলিশ।
অপরদিকে রাষ্ট্রপতিকে সরাতে কোটা বিরোধী ছাত্র সংগঠন উপদেষ্টা পরিষদকে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, ঐক্যমতের অভাবে সে ব্যাপারে জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস ব্যাপারটি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে তাঁর পদ থেকে সরানো নিয়ে সদস্যরা রাজি হলেও, পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ সাংবিধানিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও ঐক্যমত নেই। বিএনপি নেতৃত্ব ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে সরালে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিএনপি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়। কারণ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকার বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা দূর করে উন্নয়নের এবং সংস্কারের কাজে হাত দিতে পারে। কিন্তু তদারকি সরকারের প্রধান সংবাদ মাধ্যমকে বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশে এখনই নির্বাচন করার উপযুক্ত সময় আসেনি। কারণ সাম্প্রতিক গণ অভ্যুত্থানে দেশের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা যথাসম্ভব পূরণের চেষ্টা করবে তদারকি সরকার। এখন নানা সমস্যার সম্মুখীন বাংলাদেশ। সুতরাং তার নিরসন হলেই, নির্বাচনের প্রশ্ন আসে।
জামায়াত ইসলামি এবং তার সঙ্গী পাকিস্তানপন্থী দল রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে তারা বলেছে, হাসিনার আমলে নিযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতির কাজকর্মকে তারা পছন্দ করে না— তবে তাঁকে সরালে যদি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়, তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, তা তাঁরা চান না। এই পরিপ্রেক্ষিতে তদারকি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তবে বিএনপি সহ অন্যান্য দলগুলি উপদেষ্টা পরিষদকে জানিয়ে দিয়েছে, প্রস্তাবিত ওই বৈঠকে যেন আওয়ামি লিগকে ডাকা না হয়। কারণ এই দল দেশে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান যিনি এখন আমেরিকা সফর করছেন, তিনি দেশে ফিরে এলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তদারকি সরকারকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের সেনা কর্তৃপক্ষের বড় অবদান রয়েছে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, যে দল এতদিন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনেছে এবং সাধারণ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেনি, মহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছে। বিএনপি নেতাদের মধ্যে আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে দলের সদস্যদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দিয়েছে। বিএনপি’র সমর্থকদের একাংশ চায় আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা, অপর পক্ষ চায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। যারা আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করার পক্ষে, তারা বলছে, এই দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়, করতে পারে। তবে এই দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়েছে, তা জেনেও যদি মানুষ এই দলকে ভোট দেয়, তাহলে তাদের কিছু বলার নেই। অপরদিকে জামায়াত ও তার শরিক দল চায়, আওয়ামি লিগকে কখনওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। কারণ এই দল ভারতের সমর্থনপুষ্ট।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, একমাত্র নির্বাচনই কি বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে বাঁচাতে পারে? কারণ গণঅভ্যুত্থানে দেশের অনেক সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য এখনও নানা সমস্যায় ভুগছে। উন্নয়ন স্তব্ধ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। অর্থনৈতিক সংকট তীব্র। এই অবস্থায় তদারকি সরকারও বিভ্রান্ত। আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় বিব্রত। তারাও চায় বাংলাদেশে নির্বাচন। নির্বাচনের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবে এবং সেই সরকার দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। ভারতও বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখছে। শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। দিল্লির সাউথ ব্লকের এক মুখপাত্র বলেছেন, হাসিনা এখন ভারতেই থাকবেন। তাঁর সম্পর্কে নানা খবর বের হলে, সাউথ ব্লকের মুখপাত্র বলেন, সেসব ভিত্তিহীন। তা নিয়ে কোনও মন্তব্য চলে না। বাংলাদেশে আওয়ামি লিগকে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না বলে কিছু মানুষ মনে করেন।
বাংলাদেশ যখন ভারতের সহায়তায় এবং সাহচর্যে স্বাধীন হল, তখন ওই দেশের লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি। এখন দেশের লোকসংখ্যা ১৬ থেকে ১৭ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুর সংখা দুই কোটির ওপর। গণ অভ্যুত্থান কালে হিন্দুদের ওপর ব্যাপক উৎপীড়ন চলেছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদারকি সরকারের আমলেও সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হয়নি। যদিও প্রধান উপদেষ্টা জোর গলায় বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার তিনি বন্ধ করবেনই। পারেননি। হিন্দুরা এবার দুর্গাপুজো করেছে চরম আতঙ্কের মধ্যে। পুজোর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান নির্মীয়মান দুর্গা প্রতিমা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এদিকে ঢাকা সহ অন্যান্য স্থানে ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন মিছিল-মিটি করেই চলেছে। দেশের মানুষ সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করছেন।
অপরদিকে পাকিস্তানপন্থী কিছু মানুষ বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত পরিবর্তনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকারও পরিবর্তন চায়। এই অবস্থায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? তদারকি সরকারও বুঝতে পেরেছে নির্বাচনের পথে অনেক বাধা। সুতরাং বাংলাদেশ কি এইভাবেই চলবে? আবার কিছু মানুষ সেনাশাসনের কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাই চরম সংকটে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষজন।