বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভেঙে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন ভাবমূর্তিকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না

হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলদেশে ভাঙা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি। ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাংলাদেশের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের আয়োজনের আভিজাত্যকে দ্বিতীয় বার স্বাধীনতা উদযাপনের নামে যে তাণ্ডব চলে,তার মধ্যে শুধু লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যালীলা বা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে নৃশংস অত্যাচারই শুধু নেই, তার সঙ্গে সে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে ধ্বংস করার আত্মঘাতী ধ্বংসলীলার ভয়ঙ্কর পরিণতি নির্বিচারে এতদিনের গড়ে তোলা আত্মবিশ্বাসকেই ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। সেখানে যেভাবে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৭ মার্চ ১৯২০-১৫ আগস্ট ১৯৭৫) মূর্তি থেকে তাঁর ছবিকে ভেঙে গুড়িয়ে দক্ষযজ্ঞের মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার আয়োজন চলে, তা শুধু বেদনাদায়কই নয়, কল্পনাতীত বিস্ময়কর। কেউ কখনও স্বপ্নেও তা ভাবতে পারেননি। আফগানিস্তানে তালিবানি স্বাধীনতা লাভে যেভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষে বিশালাকার বুদ্ধদেবের মূর্তিগুলি ভাঙা হয়েছিল,তার সঙ্গেও এই বীভৎস অসভ্যতাকে মেলানো যায় না। যে মানুষটি জীবনের সর্বস্ব দিয়ে জীবনসংগ্রাম করে বাংলাদেশ নামক দেশটিকে গড়ে তুলেছেন,সেই শেখ মুজিবুর রহমানের (আগস্ট ১৯৭৫) দীর্ঘায়িত মূর্তিকেই ভেঙে নিশ্চিহ্ন করার বীভৎস আয়োজন চলে নির্বিরোধী স্বাভাবিকতায়! তাঁর উত্তরসূরি আত্মজা তথা সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বৈরাচারী অরাজকতার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যে তীব্র জনরোষের প্রতিফলনে নৃশংসতার পরাকাষ্ঠায় সেই ট্র্যাজিক পরিণতি সারা বিশ্বের আত্মসচেতন বাঙালিকে নির্বাক করে তোলে! সেখানে ধর্মীয় বিদ্বেষ বা জাতিবিদ্বেষও ছিল না। তাঁর স্বজাতির লোকেরাই তাঁকে নির্বিচারে অস্বীকার করার তাণ্ডবে মেতে ওঠে, দীর্ঘদিনের জমানো প্রতিশোধের আগুনে নিমেষেই ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লাগে। অথচ একুশ শতকের সূচনা দশকেও শেখ মুজিবুর রহমানের তীব্র জনপ্রিয়তা ছিল। ২০০৪-এ বিবিসি আয়োজন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতিযোগিতায় তিনিই জনগণের ভোটে বিস্ময়কর ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পিছনে ফেলে প্রথম নির্বাচিত হন। এতে যে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিপুল সমর্থন ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল জনভিত্তির মূলেও যে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দেওয়া,তাও অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে গড়ে তুলে তিনি বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত করেছেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস,তাঁকেই সেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার আয়োজন করে চলেছে তাঁরই স্বজাতি,তাঁরই দেশবাসী। তাঁকে অস্বীকার করা মানেই তো বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। সে দেশের নামকরণেও যে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা বর্তমান! তিনিই দেশটির নামকরণ করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতা তাঁর সংগ্রামী জীবনের মধ্যেই প্রতীয়মান। আত্মঘাতী বর্বর বাঙালি তাঁর মূর্তি ভাঙার খেতে উঠেছে। অথচ বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গেই তাঁর অবিচ্ছেদ্য যোগ, বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছিন্ন নিবিড় বন্ধন। দেশটির সঙ্গেই তাঁর বেড়ে ওঠা,গড়ে তোলা জীবন একাত্ম হয়ে রয়েছে।

আসলে বাংলাকে দেশের সঙ্গে জুড়ে বাংলাদেশ গড়ে তোলাই শেখ মুজিবের জীবনের ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠেছিল। সেখানে তাঁর অতুলনীয় ভূমিকাই তাঁকে শুধু স্বদেশে নয়,বিদেশের বাঙালির মনেও চিরস্মরণীয় করে তুলেছে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানের অধীনে পূর্ববঙ্গের বাঙালির স্বপ্ন যে ব্যর্থ হয়েছে, তা মাতৃভাষার অধিকার রক্ষিত না হওয়ার মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে অন্যতম দাপ্তরিক ভাষার প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। এজন্য ১৯৪৮-এর ১১ মার্চে সে দেশে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। তার কিছুদিন পর ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহম্মদ আলি জিন্না পূর্ববঙ্গে এসে জানিয়ে যান উর্দুই সে দেশের রাষ্ট্রভাষা। ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি সেকথা আবার স্মরণ করিয়ে দেন। এতে স্বাভাবিক ভাবেই সেই ভাষা আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতা লাভ করে। অচিরেই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। ১৯৪৯-এর ২৩ জুন হোসেন সোহরাওয়ার্দি, আব্দুল হামিদ খান ভাসানি বা মৌলানা ভাসানি, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখদের নিয়ে সেদেশের প্রথম বিরোধী দল ‘আওয়ামি মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করে নেতৃত্ব প্রদানে তাঁর স্বকীয়তাকে আপনাতেই প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, কারাবাসও করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূচনাতেও আন্দোলন করে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের নিয়ে আন্দোলন করেও কারাবরণ করেছিলেন। ‘আওয়ামি মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার সময়েও তিনি জেলে ছিলেন। অথচ তাঁর অনুপস্থিতিতেও তাঁকে লীগের একনম্বর যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। অন্যদিকে শেখ মুজিব রাজনীতিতে বেঙ্গল মুসলিম লীগের অগ্রণী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্নে সক্রিয় হয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের মোহও তিনি একসময় কাটিয়ে ওঠেন। কেননা বিভেদকামী শক্তি দিয়ে দেশের মানুষকে যেমন আপন করা সম্ভব নয়, তেমনই তার সর্বজনীনতার অভাবে রাজনৈতিক ঐক্যও গড়ে তোলা অস্বাভাবিক। আসলে তাঁর মধ্যে অসম্প্রদায়িক উদারতাই শুধু নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার মানবিক মুখেও কোনোরকম দোলাচল ছিল না। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, পরবর্তীতে ১৯৫৫-এর ২১ অক্টোবরে লিগের কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের সদিচ্ছায় ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দেওয়ায় ‘আওয়ামি লীগ’ সর্বজনীনতা লাভ করে। তাঁর প্রতি আমজনতার আবেগ ও অনুরাগ এবং আস্থা ক্রমশ তাঁকে দেশের ত্রাতার আসনে আন্তরিক করে তোলে।


পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন যেভাবে ক্রমশ তীব্রতার মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী মানুষের কণ্ঠে ভাষা জুগিয়েছে, সেভাবেই পাকিস্তান সরকার সেই মুক্তিকামী ভাষাকে নীরব করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে । এজন্য সে দেশের সরকারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারে আগ্রাসী শাসন নেমে আসে। সেখানে ভাষা আন্দোলনে ভাষার অধিকার মিললেও বাংলার অস্তিত্বকে পাকিস্তানীকরণ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৫-তে পাকিস্তানের গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সংবিধানে প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা রাখা, দেশের নামে ইসলামি প্রজাতন্ত্র না করা এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের কথা জোরালোভাবে তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন। অথচ ১৯৫৬-তে সেই গণপরিষদে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের সংবিধানে কোনোটাকেই মান্যতা দেওয়া হয়নি । অন্যদিকে ‘পূর্ববঙ্গ’ শুধু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হয়ে গেল না, সেই বাংলাতেও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ছায়া কায়া বিস্তার করে। সেক্ষেত্রে সেই বাংলার প্রাদেশিক সরকারও পরাধীনতাকেই উজ্জীবিত করে চলে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী কায়েমী স্বার্থের শিকার হিসাবে সুদূরবর্তী পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দাসত্ব চেতনাই সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিমানসে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। সেদিক থেকে প্রাদেশিক সরকারের অস্থিরতার পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারে ক্ষমতার পালাবদলের তীব্র প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ জনমানসে বিদ্রোহের মেঘ জমে উঠেছিল। সেক্ষেত্রে শুধু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল ক্রান্তিকালের বিদ্রোহ। যার পরিণতি ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অস্থিরতায় পূর্ব পাকিস্তানের উপর আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ তীব্রতর রূপ লাভ করে। ১৯৫৮-তে ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আয়ুব খানের নেতৃত্বে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। আবার সেই আয়ুব খানই রাষ্ট্রপতিকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে নিজেই ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির আসনে সমাসীন হন। ১৯৬২-তে সামরিক শাসন প্রত্যাহারিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কঠোর মনোভাবের কোনওরকম পরিবর্তন ঘটেনি, বরং আরও নৃশংস হয়ে ওঠে। সেখানে যেকোনওভাবে স্বাধীনতা-সংগ্রামকে প্রতিহত করার মরীয়া প্রয়াসে স্বাভাবিক ভাবেই নির্মম অমানবিক নিষ্ঠুরতা যেভাবে নেমে এসেছে, তেমনই তার প্রতিক্রিয়ায় গণআন্দোলনে অভিমুখে দেশের স্বাধীনতাই আন্তরিক হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে দেশনায়কের ভূমিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদী ভূমিকা বর্তমান। মূলত তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন জেগে ওঠে। এজন্য তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক প্রস্তুতিও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ১৯৫৬-তে পূর্ব পাকিস্তানের জোট সরকারের মন্ত্রী হয়েও দলীয় কাজে বেশি করে সময় দেওয়ার জন্য মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির মাধ্যম তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ক্রমশ তাঁকে জননেতার মান্যতায় আন্তরিক করে তোলে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে তাঁর অভিভাবকসুলভ ভাবমূর্তি স্বাভাবিক ভাবেই আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। ১৯৫৭-তে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। অন্যদিকে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগেই থাকেন। দেশে সামরিক শাসন জারির সময়ে কয়েকবছর কারান্তরালে ও স্বগৃহে অন্তরীণ ছিলেন। সেদিক থেকে স্বাধীনচেতা শেখ মুজিব পাকিস্তানের সরকারের দেশের প্রধান বিরোধী বিদ্রোহী শক্তির লক্ষ্যে আপনাতেই নজর কেড়েছিলেন।

১৯৬৩-তে সোরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে শেখ মুজিব সেই মুখ থেকে প্রমুখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। ১৯৬৪-তে পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করে তাঁর ভাবমূর্তি সর্বজনীন করায় আরও নিবিড়তা লাভ করে। আর তাঁর পূর্ব পরিকল্পিত প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে নিয়ে দেশের বিরোধী দলগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলায় সক্রিয় হন। ১৯৬৬-এর ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সম্মেলনে ‘৬ দফা দাবি’ পেশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই ছয় দফার মূলেই ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাবনা হিসাবে বিবেচিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের অখণ্ডতা বিনষ্ট হওয়ার ভয়ে পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে এবং তার প্রতিবাদে ৭জুন পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গণআন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবের আহবানে সেই গণআন্দোলনে তাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিমানসকে প্রাণিত করে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারও তাঁকে বারবার গ্রেফতার করে প্রতিহত করায় অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বন্দি অবস্থাতেই দেশদ্রোহের চরম অভিযোগ নেমে আসে। ১৯৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি ভারতের সঙ্গে যোগসাজশ করে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আরও ৩৪ জন সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ রুজু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই মামলায় প্রমাণ হিসাবে যেসব কাগজপত্র উপস্থাপিত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি চিরকুটে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ’। সেক্ষেত্রে দেশটির নামকরণে যে শেখ মুজিবুরের ভূমিকা ছিল,তা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। আবার সেখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের নামকরণ যে তাঁরই, তা অচিরেই স্পষ্টতা লাভ করে। ১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বরে সুরাবর্দির ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় শেখ মুজিবুর রহমান পাক সরকারের ‘বাংলা’ শব্দকে মুছে ফেলার চক্রান্ত বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর স্পষ্ট বার্তা ব্যক্ত করেন: ‘জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বস্থানীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।’

অন্যদিকে পাক সরকারের কঠোর মনোভাবে সেই মামলা বিশেষ আদালতে ১৯৬৮-এর ১৯ এপ্রিল বিচারের মাধ্যমে যত সক্রিয় হয়ে ওঠে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনমানসে ততই শেখ মুজিবের প্রতি একাত্মতাবোধ আন্তরিক হয়ে ওঠে। ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সান্ধ্যআইনকে ভঙ্গ করে পাকস্তানি সামরিক সরকারের উৎখাতে গণঅভ্যুত্থানের মুলে ছিল শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি। তাঁকে তখন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়ার বন্দোবস্ত চলছিল। তীব্র গণআন্দোলনের চাপে পড়ে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন পাক সরকার। শুধু তাই নয়, সেই অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করতে ১৯৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ সরকারিভাবে তুলে নেওয়া হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভের পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্সের ময়দানে দশ লক্ষ লোকের জনসমাবেশে শেখ মুজিব শুধু বিপুল সংবর্ধনাই লাভ করেননি, আমজনতার ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলদের নিয়ে আয়ুব খানের গোল টেবিল বৈঠক আহবান করে শেষে তা ব্যর্থ হলে তিনি ২৫ মার্চ পদত্যাগ করেন। সেদিক থেকে শেখ মুজিবের ‘৬ দফা দাবি’কেই সামনে রেখেই চলে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার স্বাধীনতা-সংগ্রাম। আর সেই স্বাধীন-সংগ্রামের মধ্যেও সমাজমানসের বহুস্তরীয় প্রতিবাদী-প্রতিরোধী চেতনাও বিস্তার লাভ করেছিল। সেই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যেই তা প্রকট হয়ে ওঠে। সমাজের তৃণমূল স্তরে গণআন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আদর্শের বিস্তার বিশেষভাবে স্মরণীয়।

পূর্ব-বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব সেভাবে ছিল না। অন্যদিকে কৃষিপ্রধান হওয়ায় সে দেশে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের দল হিসাবে শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের ‘শ্রমিক-প্রজা পার্টি’ই ১৯৫৩-তে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’তে পরিণত হওয়ায় মূল ধারার রাজনীতিতেও স্বতন্ত্রভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতাকে তীব্র করে তুলতে পারেনি। সেদিক থেকে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থী রাজনীতির আদর্শ বিস্তার স্বাভাবিক হয়ে আসে। অন্যদিকে পূর্ব বাংলাতে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বরাবর সক্রিয় ছিল। সেক্ষেত্রে জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে উচ্চ শিক্ষায় সমাগত ছাত্রদের মাধ্যমে সে দেশে বামপন্থী আদর্শ বৃহত্তর গ্রামীণ বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তার প্রভাব না থাকলেও গ্রামবাংলার জনজীবনে তার আবেদন যে তীব্র হয়ে উঠেছিল, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেই তা প্রতীয়মান। অন্যদিকে ভারতে স্বাধীনতা-উত্তর পরিসরে ১৯৫০-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় এবং সক্রিয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতায় ফিরে আসে। সরকারিভাবে বিভিন্ন জনকল্যাণকর আইন প্রণয়নের ফলে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার উদ্যোগও চলতে থাকে। জনস্বার্থে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টিই হয়ে ওঠে প্রমুখ। অন্যদিকে ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। সেখানেও চীন ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট আদর্শ নিয়ে মতভেদ। ১৯৬৪-তে সরকারিভাবে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দুটি দলে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। সেদিক থেকে পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির স্বতন্ত্র প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে গড়ে না উঠলেও পরোক্ষভাবে নামান্তরে তার অস্তিত্ব নানাভাবেই বিস্তার লাভ করে। সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখ্য। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পূর্ব বাংলার তৃণমূল স্তরে বামপন্থী জননেতা হিসাবে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। চীনপন্থী হিসাবে তিনি ‘লাল মাওলানা’ হিসাবে পরিচিতি পান। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৭-এর ২৫ জুলাই ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার মাধ্যমে তাঁর সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর লক্ষ্যে ছিল সমাজবিপ্লব। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার চেয়ে ওপার বাংলার আমজনতার স্বার্থে তাঁর অনন্য ভূমিকা তাঁকে জাতীয় রাজনীতির বিকল্পেও তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেয় । এজন্য প্রয়োজনে তিনি পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করেছেন, প্রয়োজনে আবার তার তীব্র বিরোধিতায় নেমেছেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবের ছয় দফা দাবিকে তিনি সমর্থন জানাননি। ১৯৬৭-তে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি চীনপন্থী ও রাশিয়াপন্থীতে দ্বিখণ্ডিত হয় এবং মওলানা ভাসানী চীনপন্থীদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনিই আবার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসামিদের মুক্তির দাবিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ব্রতী হন।

অন্যদিকে পূর্ব বাংলার ছাত্রসংগঠনের যোগ অত্যন্ত অবিচ্ছেদ্য। সরকারবিরোধী অবস্থানে উচ্চশিক্ষিত ছাত্রসমাজই সেখানে জাতীয় আন্দোলনের শরিক হয়ে উঠেছে বরাবর। ভাষা আন্দোলনের সাফল্যে ছাত্রদের প্রতিবাদী ভূমিকাই প্রতীয়মান। অন্যদিকে ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯-এ পূর্ব পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয়তা্র মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে। সেখানে ১৯৬৯-এ ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘১১ দফা কর্মসূচী’র মধ্যে যেমন শেখ মুজিবের ‘৬ দফা দাবি’র স্বায়ত্ব শাসন রয়েছে, তেমনই তাতে দেশের জনগণের (ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মী প্রমুখের) নানা দাবি দাওয়াও বর্তমান। অন্যদিকে ১১ দফার অব্যবহিত পরিসরেই পূর্ব পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরকম আটটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশান কমিটি’। শুধু ছাত্রদের বা রাজনৈতিক দলের মধ্যেই নয়, কৃষজ-শ্রমিক থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ায় তা সহজেই গণঅভ্যুত্থানে সামিল হয়। অন্যদিকে শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে গণতন্ত্রের দাবিতে শুধুমাত্র স্বৈরশাসকবিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্থানীয় পরিসরে শাসক-শোষকবিরোধী বিচিত্র অভিমুখে জণজাগরণ ও গণচেতনার পরিসরে জনগণের প্রতিবাদী চেতনা প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে সমাজের নানাভাবে শোষিত-মানুষের মানুষের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠাটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছড়িয়ে যায়। সেদিক থেকে জনমানসে দীর্ঘদিনের লালিত ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিবাদ প্রতিশোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিবাদী স্রোত একখাতে প্রবাহিত হয়ে মহাস্রোতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সেখানে সরকারের কাছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অপূর্ণ দাবিদাওয়াও সেই প্রতিবাদী আন্দোলনকে প্রাণিত করে। বিশেষ করে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ অকুতোভয় প্রতিবাদী আন্দোলনে রাজপথও মুখর হয়ে ওঠে। আর সেই মানুষদের পাশে সক্রিয় ভাবে সামিল হয়েছিল ছাত্রসমাজ। উচ্চশিক্ষিত ছাত্ররাই সেখানে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে শহরের শিল্পাঞ্চল থেকে বাংলার বৃহত্তর গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে শোষিত-শাসিত মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে প্রতিবাদে সামিল করার দিক থেকে বামপন্থী ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা বর্তমান। ‘১১ দফা কর্মসূচী’র নেপথ্যে সেই বামপন্থী ছাত্রসমাজই। আবার সেখানেও বামপন্থী রাজনীতির সেই দ্বিধাবিভক্ত প্রকৃতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কেউ চীন বা পিকিংপন্থী, কেউ মস্কোপন্থী। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের কায়েমী স্বার্থে সুবিধাভোগী শ্রেণির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সেখানে নানাভাবে সমান সক্রিয়। সেদিক থেকে সমষ্টিচেতনা থেকে ব্যক্তিমানসের বহুস্তরীয় সমাজবাস্তবতার নিরিখে পূর্ব পাকিস্তানের গণঅভ্যুত্থান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সক্রিয় করেনি, জনজাগরণের গণসংগ্রামকে মূর্ত করে তুলেছে।

সেদিক থেকে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান অসফল হলেও তার অনস্বীকার্য প্রভাব অচিরেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর যাঁর নেতৃত্বাধীন গণ অভ্যুত্থানের নিভন্ত আগুন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মশাল জ্বেলে উঠেছিল, তাঁর নামই শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ঐকান্তিক আহ্বান সাড়া দিয়েই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর বাঙালি স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ায় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম হয়। সেখানে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ভারত সরকারের সহযোগিতায় সুদীর্ঘ প্রায় নয় মাসের (১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর) মুক্তিযুদ্ধে অপরাজেয় থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন,তাতেই তাঁর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির শিরোপা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলেও পাকিস্তান সরকার সেই ফলাফলকে অস্বীকার ও উপেক্ষা করে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে ওপার বাংলার অরাজকতা ও স্বৈরাচারী শাসন তীব্রতর হয়। দমনপীড়নের মাধ্যমে পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্রতার স্বপ্নকে নির্মূল করায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার বার্তা দিয়ে তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেন। ইতিপূর্বেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের মধ্যে রাতে পাক সরকার সেনা নামিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে দেয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান। এজন্য সেই রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ ডিসেম্বরে তাঁকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও যুদ্ধের দ্রুত পালাবদলে তা কার্যকর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর অবশেষে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি সারা বাংলাদেশ তাঁর জন্য অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটে।

সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যেও রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির কথা ঘোষণা হতেই নতুন দেশের মানুষের মুখে মুখে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি মুখরিত হতে হতে থাকে। সেদিনের দেশের আমজনতার আনন্দঘন রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর ‘বিপুলা পৃথিবী’ আত্মজীবনীতে জীবন্ত করে তুলেছেন। পাকিস্তান থেকে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, অচিরেই সে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ১২ জানুয়ারি তিনিই সে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপক্ষেতা আধারে বাঙালির জাতীয়তার সমন্বয়ে তাঁর নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অপর নামই নন, দেশটির অস্তিত্বের সঙ্গেই তাঁর নাম অবিচ্ছেদ্য, অবিচ্ছিন্ন। স্বাধীন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজেই দেশটির সার্বভৌমিক অস্তিত্বকে প্রাণ দান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর গুরু দায়িত্বভার নিয়ে বছর তিনেক পর ১৫ আগস্টে একদল সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে নৃশংসভাবে তিনি সপরিবারে খুন হন। দেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিবের ভূমিকার সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু দেশটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর অবিসংবাদী ভূমিকা আপনাতেই বাঙালিকে আনত করে, গর্বে তার বুক ভরে যায়, আত্মবিশ্বাসে তার মাথা উঁচু হয়ে ওঠে। তাঁর মহাপ্রাণের সঙ্গে একমাত্র নেলসন ম্যান্ডেলার তুলনা করা চলে। প্রায় সাতাশ বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র করেছিলেন। সেখানে দেশের জন্য শেখ মুজিব অসংখ্যবার কারাবরণ করে পঞ্চান্ন বছরের জীবনেই তেরো বছর কারাবন্দি ছিলেন। শেষে নিজের দেশের বিশ্বাসঘাতক সামরিক কর্মকর্তাদের হাতেই নির্মম ভাবে সমূলে বিনাশের মধ্যেও তাঁর অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয় দেশটির আধিপত্যে তাঁর জনপ্রিয়তা কত সুগভীর ছিল,কত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল।

খুন করেও তাঁর ভাবমূর্তিকে মুছে ফেলা যায়নি। বরং আরও বেশি করে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব আপামর বাঙালির মন ও মননে ঘনিষ্ঠ হয়ে ছড়িয়ে পরে। তারই পরিচয় ২০০৪-এ বিবিসির আয়োজনে তাঁর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে ওঠা। শুধু তাই নয়, আগুনের মধ্যে থেকে ফিনিক্সপাখির মতো তাঁর অস্তিত্ব ক্রমশ সে দেশেই অবিনশ্বর ভাবে জেগে ওঠে, জেগে থাকে। সেখানে শেখ হাসিনার উত্তরণ থেকে পতনের সঙ্গে শেখ মুজিবের মূর্তির করুণ পরিণতিকে মেলালে ঠিক হবে না। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ‘বাহান্নর দিনগুলো’তে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের উপরে পাক সরকারের গুলি ছোঁড়াকে ‘কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ’ বলে অভিহিত করেছেন। সেখানে ছাত্রদের মৃত্যুর নীরবতাই ভাষা আন্দোলনে মানুষের মুখে ভাষা জুগিয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের গুলি চালানোয় কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই সরকার উৎখাতে পরিবর্তিত হয়ে বঙ্গবন্ধুরই মূর্তি ভেঙে ফেলে এবং মূর্তির মাথায় প্রস্বাব করে বাঙালিকেই হতবাকে নির্বাক করে তোলে, ভাবা যায়! আসলে আমরা ভুলে যাই, ফুঁ দিয়ে আগুন নেভে, আবার ফুঁয়ে নেভা আগুন জ্বলে ওঠে। সেক্ষেত্রে শুধু শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করলেই আমাদের দায় ফুরিয়ে যায় না, আত্মসমালোচনাও জরুরি। এই মূর্তি ভাঙা নিয়ে কোনওরকম প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ দেখা গেল না, উল্টে তাঁর অস্তিত্বকে সরকারের সঙ্গে জুড়ে অস্বীকার করার প্রবণতা জারি থাকে। সেখানেও তাঁর নীরবে সরব অস্তিত্ব আজও সমান সচল। অস্বীকারের মধ্যেই যে স্বীকারের আভিজাত্য প্রকট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান তো শুধু শেখ হাসিনার পিতা নন, তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক,বিশ্বের আপামর বাঙালির বঙ্গবন্ধু। তাঁর মূর্তি ভাঙা যায়,গড়াও যায়, কিন্তু তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন ভাবমূর্তি ভাঙার সাধ্য কারও নেই। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মনেপ্রাণে জেগে থাকে নীরবে, নিভৃতে, সংগোপনে, নিরন্তর।