শোভনলাল চক্রবর্তী
সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর বিখ্যাত সংলাপ মনে পড়ে গেল ইতিহাসের সঙ্গে কুস্তির গৈরিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য যখন খুঁজে পেয়েছে তার নতুন ‘শত্রু’— ঔরঙ্গজেবের সমাধিকে তখন। মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শম্ভোজি নগর জেলায় অবস্থিত সমাধিস্থলটি ভেঙে ফেলার নিদান দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ উদয়নরাজে ভোঁসলে; তার প্রতিক্রিয়ায় নাগপুরে বিপুল অশান্তি ঘটল। ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র কী ভাবে চলে, মহারাষ্ট্রের ঘটনাক্রম তার এক প্রত্যক্ষ উদাহরণ। বিতর্কের সূত্রপাত ছাওয়া নামক এক বলিউডি ছবিতে শিবাজি-পুত্র শম্ভোজি মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দ্বৈরথের অনতি-ঐতিহাসিক রূপায়ণে। সেই সূত্র ধরেই বিজেপি-শিবসেনা জোটের একাধিক নেতা-মন্ত্রী জাগিয়ে তুলতে চাইলেন ‘মারাঠি অস্মিতা’। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগ দিলেন সেই বিদ্বেষ-যজ্ঞে; বললেন, তিনিও চান না যে, তাঁর রাজ্যে ঔরঙ্গজেবের সমাধি থাকুক, কিন্তু তাঁর হাত বাঁধা, কারণ সমাধিটি এএসআই-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও হুঙ্কার দিলেন, “যিনি ঔরঙ্গজেবকে নিজের আদর্শ বলে মনে করেন, তাঁর কি ভারতে থাকার অধিকার রয়েছে?” নাগপুরে ঔরঙ্গজেবের কুশপুত্তলিকা দাহ করল হিন্দুত্ববাদীরা, তার গায়ে জড়ানো সবুজ কাপড়। গুজব তৈরি হল, সেই কাপড়ে কোরানের আয়াত লেখা রয়েছে। তৈরি হল অশান্তি— পুলিশ ধরপাকড় আরম্ভ করল; দেখা গেল, যাঁরা গ্রেফতার হলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান। তার কয়েক দিনের মাথায় সেই ঘটনায় দুই প্রধান অভিযুক্তর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল— বলা হল, নির্মাণ অবৈধ ছিল। অর্থাৎ, বিজেপির রাজত্বে ইদানীং যেমনটা হওয়া দস্তুর, মহারাষ্ট্রের কাহিনিও এসে দাঁড়িয়েছে সে বিন্দুটিতেই।
সে কারণেই, ঔরঙ্গজেবের সমাধির প্রশ্নটিকে নিছক এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসাবে না-দেখে, দেখতে হবে একটি প্রতীক হিসাবে। একদা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন যে ভাবে সংখ্যালঘু মানুষকে কোণঠাসা করতে তৎপর, এই সমাধিক্ষেত্রটি সেই আখ্যানের একটি উপাদানমাত্র। ঔরঙ্গজেব মানুষ বা শাসক হিসাবে কেমন ছিলেন, তা ইতিহাসবিদদের আলোচনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু একুশ শতকের সমাজজীবনের প্রশ্ন হতে পারে না। তাঁর সমাধিস্থলটিও এক ঐতিহাসিক অস্তিত্বমাত্র, তার উপরে বিশেষ তাৎপর্য আরোপ করারও কথা নয়। কিন্তু, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সচেতন ভাবেই সেই কাজটি করে। তা শুধু ইতিহাসকে অস্বীকার করার, বা ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার প্রকল্প নয়— তার কারণটি গভীরতর। ইতিহাসকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তা বর্তমানের সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা বাড়ানোর প্রকল্প। সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে সংঘাত বাধা এক প্রকার অনিবার্য, এবং সেই সংঘাত দমনের নামে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রযন্ত্র আরও এক বার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সংখ্যালঘু মানুষের উপরে। বুঝিয়ে দিতে পারে, এই দেশে গৈরিক বুলডোজ়ার যে কোনও দিন তাঁদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে পারে, রাষ্ট্র তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহের ভয়ানক অভিযোগ।
অতীত আসলে বর্তমানের নিপীড়নের যুক্তিমাত্র।উস্কানির এই রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন হওয়া প্রত্যেক উদারবাদী ভারতীয়র কর্তব্য। মনে রাখা প্রয়োজন, মহারাষ্ট্রে যা হল, তা নিতান্তই একটি বলিউডি ছবিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আবেগের বিস্ফোরণ নয়— তা একটি সুপরিকল্পিত ঘটনাক্রম। এবং, শুধু অতীতকে ব্যবহার করেই নয়, যে কোনও উপলক্ষকেই এই কাজে লাগাতে পারে দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র। যেমন, এপ্রিলের গোড়াতেই রামনবমী আসছে। তার মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘাত ইদানীং ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। লক্ষ করার, এ বারও তেমন সংঘাত ঘটলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়। আশঙ্কা হয়, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কঠোরতম ধারায় অভিযোগ দায়ের, আইনবহির্ভূত ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রবণতা অব্যাহতই থাকবে। সংখ্যালঘুকে দমন করার কোনও সুযোগ গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা হাতছাড়া করবেন না।
এদিকে, মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজ়েব নন। বরং ‘আইকন’ বা নায়ক হিসেবে তাঁর বড় ভাই দারা শিকোকে দেখা উচিত বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন আরএসএসের সহকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবলে। তাঁর কথায়, ঔরঙ্গজ়েবের নীতি কোনও ভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। এ দেশের প্রেক্ষিতে বরং দারা শিকোর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। দু’দিন আগে বর্তমান সময়ে ঔরঙ্গজ়েব বিতর্ক অর্থহীন বলে মন্তব্য করে আরএসএস নেতৃত্ব। ঔরঙ্গজ়েব প্রশ্নে বিরোধ ঠিক কোথায়, তা স্পষ্ট করেছেন আরএসএসের শীর্ষ নেতা।সম্প্রতি নাগপুরে ঔরঙ্গজ়েবের সমাধিকে ঘিরে হওয়া বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে হোসবলে ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী ঐতিহাসিক চরিত্রকে আইকন বানানো নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলেন। তাঁর কথায়, যারা গঙ্গা-যমুনি সংস্কৃতির দোহাই দেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন— কেন দারা শিকোর মতো চরিত্রকে তুলে ধরার পক্ষে সওয়াল করা হয়নি? যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল করতেন আর যাঁরা সেই সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করতেন— আমাদের কাদের তুলে ধরা উচিত, তা নিয়ে ভাবা দরকার?তার মতে, যাঁরা এ দেশের সংস্কৃতি, মাটি ও পরম্পরাকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁদের নায়ক বানানো উচিত। ঔরঙ্গজ়েব কোনও ভাবেই ওই তালিকায় আসেন না। কিন্তু দারা শিকো অবশ্যই পড়েন। ধর্ম ও জাত এখানে বিষয়ই নয়। ভগিনী নিবেদিতা খ্রিস্টান হলেও এ দেশের সংস্কৃতিকে আপন করেছিলেন। তাই তিনি শ্রদ্ধেয়।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৫ সালে দিল্লির ঔরঙ্গজ়েব রোডের নাম পরিবর্তন করে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম রোড রাখা হয়। হোসবলের কথায়, কিছু কারণ তো অবশ্যই ছিল, যে কারণে ওই নামকরণ করা হয়েছিল।ব্রিটিশদের মতো যারা মোগলদের মতো বিদেশি বহিরাগতদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরেছিলেন, তাঁরা সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে ব্যাখ্যা করেছেন হোসবলে। তাঁর কথায়, রানা প্রতাপ সেই কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামী। আরএসএসের মতে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যারা মোগল তথা বিদেশি আগ্রাসনকারীদের নায়ক বানিয়ে তাদের পক্ষে সওয়াল করেন, তাঁরা সকলেই দেশবিরোধী মানসিকতার। সেই সব মানসিকতার লোকের বিরুদ্ধে প্রয়োজন লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
যুগে-যুগে কাহিনি কিংবা লোকমুখে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে ‘খলনায়ক’ বলা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটক হোক কিংবা তার পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্য, ঔরঙ্গজেব চিরকালীন খল চরিত্রেই ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি শুধু ‘গোঁড়া’ শাসক নন, তিনি দুরাচারী, অত্যাচারী, ভ্রাতৃঘাতী নবাব। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহেরুও তাঁর বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় ঔরঙ্গজেবকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং গোঁড়া, অসহিষ্ণু শাসক হিসেবেই দেখছেন। নেহেরু লিখছেন, ‘ঔরঙ্গজেব সময়ের উল্টো দিকে ঘড়িকে চালাতে চেয়েছিলেন।’ কথায়-কথায় নেহরুকে দোষারোপে অভ্যস্ত বিজেপিও একবিংশ শতকে এসে দিল্লির রাস্তা থেকে ঔরঙ্গজেবের নাম মুছে দিয়েছে।
সত্যিই কি ঔরঙ্গজেব আদ্যোপান্ত ধর্মান্ধ ছিলেন? নাকি ইতিহাসে কল্পনার রং মিশিয়ে আখ্যান গড়ে তোলা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে ইতিহাসচর্চার ধারার আলোচনা বোধহয় একান্ত জরুরি। ঔপনিবেশিক আমলে গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের লক্ষ্য ছিল, নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে মোগলদের থেকে উন্নত প্রতিপন্ন করা এবং ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতবাসী যে অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এসেছে তা তুলে ধরা। সে দিক থেকে শেষ শক্তিশালী মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে নিশানা করেছিলেন তাঁরা। পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের কাছেও তিনি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী। সেই দায় বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক নীতি। সেই সূত্র ধরেই ঔরঙ্গজেব শুধু ইতিহাসে আটকে থাকেননি, তাঁকে নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা মিথ। সেই মিথকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে রাজনীতিও। নতুন ধারার চর্চার ক্ষেত্রেই ইতিহাস ও মিথের মাঝে থাকা ঔরঙ্গজেবকে খুঁজেছেন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রশকে। রাজসিংহাসনে শাহজাহানের উত্তরসূরির ধর্মীয় নীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ট্রশকে তুলে ধরেছেন সাড়ে তিনশো বছর আগের এক ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনার কথা। কী সেই ঘটনা?
বারাণসীর মোগল রাজকর্মচারীরা দিল্লির বাদশার কাছ থেকে ‘ফরমান’ পেলেন। সেই রাজনির্দেশে লেখা রয়েছে, মোগল বাদশার কর্মচারীদের স্থানীয় কোনও মন্দিরের বিষয়ে অযাচিত ভাবে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। আরও লিখেছেন বাদশা ঔরঙ্গজেব ওরফে আলমগীর, ‘তোমাদের নিশ্চিত করা উচিত যাতে কেউ হিন্দু এবং ব্রাহ্মণদের অত্যাচার না করে এবং তাঁরা তাঁদের এলাকায় থাকতে পারেন এবং মন্দিরে সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন।’ শুধু এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী কালেও ব্রাহ্মণদের স্বার্থরক্ষায় ঔরঙ্গজেবকে সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, বারাণসীর ভগবন্ত গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে কোনও রকম অত্যাচার না করার। এর আগেও এমন উদাহরণ আছে। দিল্লির তখতে বসার ৯ বছর পরে ঔরঙ্গজেব দান পাঠালেন গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দিরে। শুধু জমি নয়, আশপাশের এলাকা থেকে রাজস্ব আদায় করার অনুমতিও পেলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। ১৬৮৭ সালে ফের বারাণসীতেই রামজীবন গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে গঙ্গার পাড়ে জমি দিলেন দিল্লির বাদশা। সেই জমিতে ব্রাহ্মণ এবং ফকিরদের আশ্রয় গড়ে তোলা হল। ১৬৯১ সালে চিত্রকূটের বালাজি মন্দিরের জন্য মহন্ত বালকদাস নির্বাণী আখড়াকে আটটি গ্রাম ও বড় মাপের করহীন জমি দান করেছেন। ১৬৯৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খান্দেশের রঙ্গ ভট্ট নামে এক ব্রাহ্মণকে করহীন জমি দান করেছিলেন ঔরঙ্গজেব। এ সবের মাঝে ব্রাহ্মণদের ভাতাও বৃদ্ধি করছেন তিনি। ঈশ্বরদাস নামে এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষাচার্য ঔরঙ্গজেবকে ‘ধার্মিক’ বলছেন এবং তাঁর কর পদ্ধতিকে ‘বৈধ’ তকমা দিচ্ছেন।
শুধু জনৈক ব্রাহ্মণ নয়, শৈব সাধুদের প্রতিও ঔরঙ্গজেবের ‘নেকনজর’ লিপিবদ্ধ করেছেন ট্রশকে।তা হলে ঔরঙ্গজেব বছরের পর বছর ধরে গোঁড়া, ধর্মান্ধ বলে প্রচার করা হয়ে আসছিল, তিনি কোথায় গেলেন? এই প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৬৬৯ সাল। এই বছরেই কাশীর বিখ্যাত শিব মন্দির ভাঙার নির্দেশ দেন ঔরঙ্গজেব। সেখানে তৈরি হয় জ্ঞানবাপী মসজিদ। যা নিয়ে সম্প্রতি ফের বিতর্ক উস্কে উঠেছে। স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে উল্লেখ আছে, মহাদেব যে অষ্টমূর্তি বলে পুরাণে কথিত হন, তাঁরই জলময়ী মূর্তি এই জ্ঞানপ্রদায়িনী জ্ঞানোদতীর্থ জ্ঞানবাপী। বিশ্বে এই জ্ঞানবাপী মসজিদ সম্ভবত একটিই মসজিদ, যার নামটি পুরাণ-উল্লিখিত। ঔরঙ্গজেব কিন্তু এই নামটিই বহাল রেখেছিলেন, পরিবর্তন করেননি। ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির ভাঙার নির্দেশও দেন তিনি। ওই সময়ে মোগল বাদশার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মান্ধ তকমা পেয়েছেন ঔরঙ্গজেব। ভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থল ভাঙা উদারপন্থী কাজ নয় ঠিকই। কিন্তু মন্দির ভাঙার পিছনে শুধুই ধর্মান্ধতা ছিল, নাকি রাজনৈতিক কারণও ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদেরা।
মাধুরী দেশাই তাঁর বারাণসীর উপরে গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্যাথরিন আশারের গবেষণায় উঠে এসেছে, সে সময়ে দাঁড়িয়ে বারাণসীর সামন্তরা মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আবার বহু সময় ব্রাহ্মণরাও ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাকও গলাচ্ছিলেন। সতীশ চন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, বারাণসী, মুলতানের মতো এলাকার মন্দিরগুলিতে শাসক-বিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে বলেও বাদশার কাছে খবর পৌঁছচ্ছিল। তাই এ কথা বুঝতে সমস্যা হয় না যে, শাসকের ধর্ম এবং ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্ক করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মোগল বাদশা। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই জ্ঞানবাপী মসজিদের অদূরেই বিশ্বনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা সওয়াই জয় সিংহ। তিনি কিন্তু ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র ছিলেন। এই বিষয় থেকেই স্পষ্ট, শুধু ধর্মান্ধতা থাকলে মোগল আমলেই কাশীতে ফের বিশ্বনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা হত না। যেমন ইতিহাসবিদদের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, ১৬৭৯ সালের পর থেকে ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যে বড় মাপে মন্দির ধ্বংসের কথা শোনা যায় না। যদি ধর্মই একমাত্র কারণ হত, তা হলে মন্দির ধ্বংস বন্ধ হত কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ব্যক্তি ঔরঙ্গজেব ধরা দেন সে আমলের ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মানুচ্চির বিবরণেও। মানুচ্চি লিখছেন, ‘তিনি ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় সম্রাট। সব সময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন এবং যথার্থ বিচার দেওয়া বা কোনও উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টায় থাকতেন।’ নির্জনতাপ্রিয়, ঠিক-ভুল নিয়ে খুঁতখুঁতে বাদশার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখা চিঠিতেও সে সবেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। কখনও নাতিকে ‘সৎ শাসনের’ উপদেশ দিচ্ছেন তিনি, বলে যাচ্ছেন, অন্তর্দ্বন্দ্বের ঘুণ ধরা সাম্রাজ্যকে টিঁকিয়ে রাখার উপায়। সেই চিঠিতে উঠে আসছে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রজাশাসনের পরামর্শ। তবে একেবারে শেষ বেলায় মৃত্যু ও কর্মফলের ভয় যেন পেয়ে বসছে বাদশাকে। ছোট ছেলে কামবখশকে বলেছিলেন, তাঁর ভয় তাঁর মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনী ও আধিকারিকদের হেনস্থার শিকার হতে হবে। তৃতীয় পুত্র আজম শাহকে বলেছিলেন, ‘‘আমি শাসক হিসেবে ব্যর্থ এবং প্রজাদের রক্ষা করতেও ব্যর্থ। জীবনে কিছুই করতে পারল না, ঈশ্বরকেও খুশি করতে পারলাম না।’’
১৭০৭ সালে মৃত্যুর পরে খুলদাবাদের একেবারে সাদামাটা সমাধিক্ষেত্রে ঠাঁই পেয়েছিলেন তাবৎ হিন্দুস্থানের বাদশা ঔরঙ্গজেব। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছে। নিজের দেশ, হিন্দুস্থান এবং এই বস্তুজগত ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেওয়ার আগে শেষ বারের মতো চিঠি লিখেছিলেন আলমগীর। তাতে দু’ছত্রে ফুটে উঠেছিল জীবনদর্শনের সারসত্য। লিখেছিলেন, ‘এসেছিলাম একা, ফিরছিও একা।’ ইতিহাস কখনও ইশ্বরকে নিয়ে রচিত হয় না। বরং ইতিহাসের চরিত্রেরা নিখাদ রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদের গুণ যেমন থাকে, তেমনই থাকে দোষও। তথ্য এবং সমসাময়িক পরিস্থিতির আতসকাচে ফেলেই তাঁদের বিচার হয়। সেই বিচারে ঔরঙ্গজেব কি ধর্মান্ধ শয়তান, নাকি বাপ-ঠাকুর্দার সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে তৎপর এক নিখাদ রাজনীতিবিদ প্রশাসক? সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে সময় আর ইতিহাস, কতিপয় উন্মাদ রোগগ্রস্ত হিন্দুত্ববাদী নয়।