প্রশ্ন উঠেছে, জ্যোতিষশাস্ত্র কি আদৌ বিজ্ঞান? অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্র কি আদৌ সত্যে প্রতিষ্ঠিত? যাঁরা জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়ন করেননি, এ নিয়ে কোনও প্রকার অনুসন্ধান করেননি, অথচ তাঁরা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করেন, এমন মানুষেরা এই প্রশ্নের হ্যাঁ কিংবা না উত্তর দিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়বেন। কোনও উত্তর তাঁরা দিতে পারবেন না। অথচ জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁদের বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ থাকবে। আমাদের মধ্যে এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান হোক বা অবিজ্ঞান হোক-এ নিয়ে তাঁদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু, যাঁরা সত্যানুসন্ধানী, যাঁরা বিজ্ঞানমনস্ক, তাঁদের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান না অবিজ্ঞান-এই প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই ৷
এখন প্রশ্ন হল, জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান না অবিজ্ঞান – এই প্রশ্নের উত্তর দিবেন কে বা কারা? আমাদের সামনে বিজ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান। যদি প্রশ্ন উঠে – পদার্থবিদ্যা কি বিজ্ঞান? তখন কোনও পদার্থ বিজ্ঞানী বলবেন, পদার্থবিদ্যা নিশ্চয়ই একটি বিজ্ঞান এবং আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি। রসায়নবিদ, জীববিদ্যাবিদ ও মনোবিদ ইত্যাদি ওই একই দাবি করবেন। তেমনি জ্যোতিষশাস্ত্র একটি বিজ্ঞান না অবিজ্ঞান এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবেন একমাত্র জ্যোতিষী । অথবা জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে যাঁরা গবেষণা বা অনুসন্ধান করেছেন তাঁরা। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান না অবিজ্ঞান –এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী বা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পেতে পারি না। কারণ, অনুসন্ধান না করে কেউ এটাকে বিজ্ঞান বা অবিজ্ঞান সাব্যস্ত করতে পারেন না। তিনি বিজ্ঞানী হতে পারেন, অবিজ্ঞানী হতে পারেন, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক হতে পারেন। ধর্মনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ বা দার্শনিক হতে পারেন-তাতে কিছু যায় আসে না।
খুবই আশ্চর্যের কথা, কেউ কেউ জ্যোতিষশাস্ত্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে জ্যোতিষশাস্ত্র বলে কোনও শাস্ত্রই নেই, পুরোটাই মিথ্যা, পুরোটাই ভণ্ডামি। আমরা জানি, সঠিক পথে বা উপযুক্তভাবে অনুসন্ধান না করে কোনও বিষয়কে স্বীকার বা অস্বীকার করা, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা বিজ্ঞানমনস্কতার লক্ষণ নয়। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্র নামে যে একটা বিষয় আছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই । তা না হলে জ্যোতিষশাস্ত্র কি আদৌ বিজ্ঞান-এই প্রশ্নটিই অবান্তর এবং অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, অস্তিত্বহীনতা নিয়ে কোনও প্রকার আলোচনা বা তর্ক-বিতর্ক হতে পারে না। অতএব, জ্যোতিষশাস্ত্র নামক তথ্যকে আমরা অবিশ্বাস বা অস্বীকার করতে পারি না। তথ্যকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রমান নয়। কারণ, বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে সত্যমনস্কতাকেই বোঝায়। তথ্যকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করলে বিজ্ঞান গড়ে উঠবে কীভাবে? সত্যাসত্য যাচাই হবে কীভাবে? কারণ, তথ্যের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর মূলতত্ত্বে পৌঁছানোই বিজ্ঞানের কাজ।
কথিত আছে, ঋকবেদের যুগে জ্যোতিষশাস্ত্রের জন্ম। ঋকবেদ যত প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রও তত প্রাচীন এবং জ্যোতিষশাস্ত্র ষড়বেদাঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রসঙ্গে এখানে স্বামী রঙ্গনাথানন্দের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, – “সমগ্র জ্ঞান এক হলেও, জ্ঞানের নানা বিভাগ ও অনুসন্ধানক্ষেত্র থাকতে পারে, আর আছেও। ভৌতবিজ্ঞানেই বহু ভিন্ন ভিন্ন অনুসন্ধান ক্ষেত্র রয়েছে। ভারতের প্রাচীন উপনিষদ এই সব বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানক্ষেত্রগুলিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। যথা, লোক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্য ভিত্তিক অনুসন্ধান, আর লোকোত্তর, অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়াতীত তথ্যভিত্তিক; এই দুরকম বিদ্যার নাম দেওয়া হয়েছে অপরাবিদ্যা ও পরাবিদ্যা, সাধারণ বিজ্ঞান ও উচ্চ বিজ্ঞান। সংস্কৃত ভাষায় বিদ্যার অর্থ বিজ্ঞান, ইংরেজী ভাষায় কথাটির অর্থ হল জ্ঞান । প্রায় চার হাজার বছর আগে ভারতে এক ছাত্রের প্রশ্নের উত্তরে এক শিক্ষক সমগ্র মানবীয় জ্ঞানকে এই দুভাগে ভাগ করেছিলেন, যা উল্লিখিত আছে, উপনিষদ নামে দশটি প্রধান বৈদিক গ্রন্থের একটিতে-মুণ্ডক উপনিষদে (১.১.৩-৬)–শৌনক নামে এক মহান গৃহস্থ বিধি অনুযায়ী আচার্য ঋষি অঙ্গিরসের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,-কাকে (কোন সত্যকে) জানলে, হে ভগবন, এই সমগ্র জগৎ প্রপঞ্চকে বিশেষভাবে জানা যায়?
তাঁকে আচার্য বললেন, দুটি বিদ্যা মানে বিজ্ঞান জানতে হয়, এই রকমই বলে থাকেন ব্রহ্মবিদগণ। (যাঁর থেকে বিশ্বের সৃষ্টি, যাঁতে স্থিতি ও লয় হয়, সেই অনন্ত শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ অদ্বৈত চরম সত্যকে যাঁরা জানেন তাঁরা) আর সে দুটি হল পরা ও অপরা। পরা হল উচ্চ এবং অপরা হল নিম্ন। আরম্ভ হবে অপরা বিদ্যা দিয়ে, যথা: ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ব-বেদ, স্বর-বিজ্ঞান, ক্রিয়া-পদ্ধতি, ব্যাকরণ, ভাষা-বিজ্ঞান, ছন্দ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-জ্যোতিষশাস্ত্র। পরে ধরতে হবে পরা বিদ্যাকে, যা দিয়ে (বিদ্যা বা বিজ্ঞান) দিয়ে অক্ষরকে, সত্যের অপরিণামী (মাত্রা)কে উপলব্ধি করা যায়।” (মনুষ্যত্ব দুর্লভ কেন, পৃঃ ৪-৫) সতিকথা বলতে কি, এই অপরাবিদ্যা এবং পরাবিদ্যা সহস্রাধিক বছর ধরে ভারতে পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে এবং হাতে হাত মিলিয়ে প্রযুক্ত হয়েছে। আর আর্য ঋষিগণ অপরা বিদ্যার অন্তর্গত জ্যোতিষশাস্ত্রের অনুসন্ধান করতে গিয়ে কঠোর ভাবে বৈজ্ঞানিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এমন কি, আয়ুর্বেদ অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধেও যাঁরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তাঁরাও সকলেই জ্যোতিষশাস্ত্রে কৃতি ছিলেন। কারণ, জ্যোতিষশাস্ত্র না জানলে বেদ-এর অর্থ বোধগম্য হয় না। তাই জ্যোতিষকে বেদের চক্ষুস্বরূপ বলা হয়েছে ।
যাই হোক, যেমন কেউ তাজমহলের নাম শুনেছেন, কেউ তাজমহল দেখেছেন, কেউ তাজমহলের ঐতিহাসিকতা নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। যিনি তাজমহলের ঐতিহাসিকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাজমহল সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান অন্যান্যদের থেকে বেশি। কেউ ঘিয়ের নাম শুনেছেন, কেউ ঘি দেখেছেন, কেউ ঘি খেয়ে তার স্বাদ বুঝেছেন, যিনি ঘি খেয়েছেন ঘি সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা অন্যান্যদের থেকে বেশি। অনুরূপে, জ্যোতিষশাস্ত্রের নাম শুনলে বা দোকানে সাজানো জ্যোতিষশাস্ত্রের বই দেখলে জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা বা এর তত্ত্ব অবগত হওয়া সম্ভব নয়। এর সত্যতা অবগত হতে গেলে সত্যানুসন্ধানীর বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়েই এগোতে হবে।
সুতরাং জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান? এই প্রশ্ন যাঁরা রেখেছেন, তাঁরা কি সত্য অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের গবেষণায় পদার্পণ করেছেন? তাঁরা আদৌ তা করেননি। বরফ শীতল কিনা, অগ্নি উষ্ণ কিনা—হাত দিলেই যেখানে বোঝা যায়, সেখানে বরফ কি আদৌ শীতল? অথবা অগ্নি কি আদৌ উষ্ণ? এমন প্রশ্ন অবান্তর! অনুরূপে, জ্যোতিষশাস্ত্র কি আদৌ বিজ্ঞান? এই প্রশ্নও অবান্তর !
বলাবাহুল্য, বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান কম্পিউটারের যুগ পর্যন্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্রই বিদ্যমান। মানুষের পক্ষে কি সম্ভব কোনও মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকা হাজার হাজার বছর ধরে? কোনও মিথ্যাই হাজার হাজার বছর ধরে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। যদি কেউ বলেন, হাজার হাজার বছর ধরে মিথ্যা টিকে থাকতে পারে। তা হলে মিথ্যা টিকে থাকারও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন। যদি কেউ বলেন, জ্যোতিষশাস্ত্র নামক মিথ্যাটি মানুষের অজ্ঞতার জন্য টিকে আছে, তাহলেও প্রশ্ন-কোন্ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত এটা?
নরেন্দ্রনাথ মাহাতো, স্কুল বাজার, মেদিনীপুর-৭২১১০১