মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো সমস্যায় সাধারণ মানুষের জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করলেন মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন৷ বাজেটের আগে সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষাকে দেশের অর্থনীতির আসল চেহারা আড়াল করার চেষ্টা বলে সমালোচনায় মুখর বিরোধীরা৷ এই সমীক্ষায় তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে প্রতারণা করার এক বিরাট কাজ সেরেছে সরকার, আড়াল করা হয়েছে সত্যকে৷ দেশের অর্থনীতির বাছাই করা সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষায়৷ অর্থনীতির সবটাই ভালো, এমন একটা ছবি তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী৷
মঙ্গলবার লোকসভায় ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন৷ সংসদের প্রথা মাফিক তার আগের দিন লোকসভায় পেশ করেন ২০২৩-২৪ সালে আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্ট৷ এই রিপোর্টের সমালোচনা করে সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, গোটাটাই সত্যের অপলাপ৷ না এতে দেশের অর্থনীতির মৌলিক জায়গাগুলি প্রতিফলিত হয়েছে, না মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মতো যে সমস্যাগুলিতে মানুষ জর্জরিত, সেগুলি মোকাবিলায় কোনও অগ্রগতির চিত্র এই সমীক্ষা রিপোর্টে উঠে এসেছে৷ বরং অবস্থার অবনতি হয়েছে৷ কর্পোরেটের মুনাফা এবং জিডিপি’র (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) মধ্যে অনুপাত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছলেও মোদির অনুগ্রহপুষ্ট ধান্দাবাজ শিল্পপতিরা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ৷ ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪-এর মধ্যে কর্পোরেটের (বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী) মুনাফা লাফিয়ে প্রায় চার গুণ হলেও ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্র বেহাল দশাতেই পড়ে রয়েছে৷ অথচ এই ক্ষেত্রেই জিডিপি’র ৪৫ শতাংশের অংশীদার এবং দেশের মোট শ্রমশক্তির ৭৫ শতাংশের কাজের জায়গা৷ ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে মোদি সরকার কর্পোরেট মহলকে বিপুল কর ছাড় দিলেও কারখানায় পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রের বিকাশ এবং চাকরির সুযোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷
খাদ্য জাতীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক বাস্তবে ২০২২-২৩-এর ৩.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬.৬ শতাংশ হয়েছে ২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে৷ ইতিমধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৭.৫ শতাংশ৷ এই পর্বেই ২০২৩ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১১১ নম্বরে৷ কৃষি ক্ষেত্রের অবস্থারও ব্যাপক অবনতি হয়েছে, যেখানে শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ কর্মরত৷ টাকার প্রকৃত দামে অর্থনীতিতে এই ক্ষেত্রের মোট মূল্য সংযোজনের বৃদ্ধির হার ২০২২-২৩-এর ৪.৭ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ সালে নেমে এসেছে ১.৪ শতাংশে৷ এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষায়৷
এই সমীক্ষায় দেশে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করা হলেও দ্রুত গতিতেই বেড়ে চলেছে বিভিন্ন খাদ্যবস্ত্তর দাম, বছরে প্রায় দশ শতাংশ হারে৷ দানাশস্যের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, তরিতরকারি ১৫ শতংশ, মশলাপাতির ১৯ শতাংশ এবং দুধের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ৷ এই পরিস্থিতিতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিব মানুষ ও মধ্যবিত্তরা৷ কোভিডের পরে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ব্যাপক অসাম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ মোদি সরকারের কৃষক-বিরোধী মনোভাবকেও চেপে যাওয়া হয়েছে সমীক্ষায়৷ অপরিকল্পিতভাবে ও অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷
আরেকদিকে সস্তার কৃষিপণ্য আমদানির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে৷ পরিণতিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষকের আয়৷ ধান, গম, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্য তেল— কোনও কিছুর কৃষকদেরই ছাড় মেলেনি৷ সরকারের খামখেয়ালি নীতি প্রণয়নে সবাই সংকটে পড়েছেন৷
সমীক্ষা রিপোর্টের দাবি, চরম দারিদ্রকে প্রায় সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব হয়েছে৷ কিন্ত্ত বাস্তবের ভারতে অর্ধেক দেশবাসী প্রতিদিন তিন বেলা খাবারের সংস্থান করতে পারেন না৷ প্রতি তিনটি শিশুর একটি অপুষ্টির শিকার৷ প্রতি চারটি শিশুর মধ্যে একটির টিকাকরণ অসম্পূর্ণ৷ দেশের এই বাস্তব চিত্র ধরা পড়েনি অর্থনৈতিক সমীক্ষায়৷ আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট সত্যের অপলাপ মাত্র৷