ধর্মীয় মৌলবাদী বাংলাদেশ কি আফগানিস্তানের পথে- এবারের বিজয় দিবসের ভাবনা

একাত্তর এ ন’মাসব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাক সেনার পূর্বাঞ্চলীয় কম্যাণ্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঢাকার পল্টন ময়দানে আত্মসমর্পন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যৌথ বাহিনীর লেঃ জেনারেল জে এস অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করলে। দিনটি সেদেশ তো বটেই এদেশেও উদযাপিত হয় বিজয় দিবস হিসেবে। গত ডিসেম্বরেও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে উভয় বাংলায় দুই রাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে।

কিন্তু এবারে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পড়শি দেশটিতে গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহে দু’দেশের সম্পর্ক এখন একেবারে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সেদেশে এখন চলছে তীব্র ভারত বিরোধী আবহ। সেদেশে নব্য ক্ষমতাসীনরা এবং মৌলবাদীরা কৃতঘ্নতায় নিজের দেশেরই গৌরবময় ইতিহাসের এক অধ্যায়কেই ভুলতে ও ভোলানোর লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর— সেজন্য শুধু সংখ্যালঘু নির্যাতন নয়, দেশকে পশ্চাৎগামী ও বিপন্ন করতেও তারা রাজী।

আসলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শচ্যুতি ও হতাশার আবহে মৌলবাদের বীজ পাকিস্তানের প্ররোচনার জলহাওয়ায় গোপনে শিকড় দৃঢ় করেছে। বস্তুত ‘একনদী রক্তে’র মূল্যে প্রাপ্ত স্বাধীনতা অস্বীকার করে এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের সে ইতিহাসকে বিস্মরণ করানোর যে চক্রান্ত চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে ভারত বিরোধী প্রচারের মাধ্যমে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে তারই চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটল যেন গত ৫ আগস্ট, জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে।


প্রসঙ্গত, ১৯৭১-এ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকবাহিনীর ২৫ মার্চের রাত থেকে চালানো বর্বরতা ও হত্যালী্লার যে মর্মন্তুদ বিবরণ বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে লন্ডনের সানডে টাইমসের তৎকালীন পাকিস্থানে কর্মরত প্রতিনিধি অ্যান্থনী মাসকারেনহাসের দশদিন ধরে পূর্বপাকিস্তান সরেজমিন পরিদর্শনে প্রস্তুত ১৩ জুনের প্রতিবেদনে। যা পড়ে শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বেই মাসকারেনহাসকে প্রাণের দায়ে সপরিবারে পাকিস্থান ত্যাগ করতে হয়।

সেই ২৫ মার্চের এক রাতেই পাক সেনাবাহিনী ঢাকার পিলখানা রাজারবাগ পুলিশলাইন এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জগন্নাথ হল ছাত্রনিবাস জহরুল হক হল ও ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে ট্যাঙ্ক ও মর্টার নিয়ে আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে অগনিত মানুষকে হত্যা করে— যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ছাত্র-ছাত্রী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ ছিলেন। সেদিন মধ্যরাতেই ঢাকা লাশের শহরে পরিণত হয়। যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ফেরুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা করার দাবিতে প্রস্তাব পেশ করে ভাষা আন্দোলনের নান্দীমুখ করেছিলেন, তাঁকে এবং তাঁর পু্ত্র দিলীপকে ২৯ মার্চ ময়নামতী ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে গিয়ে পাক সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ তাঁদের মতো শহিদদের আত্মবলিদান সেদেশে নির্বাসিত।

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে লেখা আছে— মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সংখ্যার নিরিখে সর্ববৃহৎ। প্রতিদিন গড়ে ৬০০০-১২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে যা গণহত্যার ইতিহাসে দৈনিক হিসাবে সর্বোচ্চ। ২০১৫ থেকে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালনের প্রেক্ষিতে ১৯৭১-এ তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানে সংগঠিত ঐ গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও ক্রমে জোরদার হচ্ছিল।

ইতিমধ্যে ঘটে গেল আকস্মিক এক ঘটনা যাকে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আখ্যায়িত করছেন ‘গণ অভ্যুত্থান’ আসলে যা ছিল ছাত্রদের সামনে রেখে গোপন ষড়যন্ত্রে বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা দখলের নীল নকশা— যার ফলে চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে এক ঘণ্টার নোটিশে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

এরপর থেকে চলছে একদিকে নৈরাজ্য; অন্যদিকে সহসা বৃদ্ধি পেয়েছে পাকিস্তান প্রীতি। যে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। যদিও ভারতের অকৃত্রিম এবং সক্রিয় সাহায্য (সামরিক) ও ভারতীয় সেনানীদেরও প্রাণদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্তি হলেও তা অস্বীকারে বিলম্ব ঘটেনি। চরম অকৃতজ্ঞতায় আজ সেই ভারতের বিরুদ্ধে রণংদেহী ইউনূসের বাংলাদেশ। তীব্র ভারত-বিদ্বেষ, আক্রোশ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় সমাজমাধ্যমে ঘোরা একটি দৃশ্য (যার সত্যতা এখনো চ্যালেঞ্জ হয়নি) থেকে যাতে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে প্রবেশ ও চলাচলের পথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পেতে দেওয়া ভারতের জাতীয় পতাকা ইচ্ছাকৃতভাবে মাড়িয়ে যাচ্ছে দু’টি ছাত্রী। দু’টি দেশের সম্পর্ক এখন তলানিতে হলেও জাতীয় পতাকার এমন অবমাননা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ক্রোধান্বিত ও বেদনাহত করবে ভারতবাসীকে।

চলছে রক্তরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক ও কৌশলী অপপ্রয়াস— সঙ্গে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনে নেমে এসেছে নতুন করে অত্যাচার ও হেনস্থা। প্রশাসন হয় নির্বিকার, নয় তো অপরাধীদের মদতদাতা। বাংলাদেশের বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিভিন্ন আলোচনায়ও সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমনকি ‘পণ্ডিত’ ভাষ্যকাররাও কৃতঘ্নতায় অতীত ভুলে গিয়ে দ্বিধাহীন নির্লজ্জতায় একথা উচ্চারণ করছেন যে একাত্তরে ভারত নিজের স্বার্থে সেদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল পাকিস্তানকে ভাঙ্গার জন্য। অথচ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম থেকেই তার দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিশাল ভৌগলিক ব্যবধান এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মৌলিক ভিন্নতা ছিলই। ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র প্রাপ্তির প্রাথমিক আবেগ অন্তর্হিত হবার পর সাহিত্যিক রুশদির ভাষায় ‘ইনসাফিশিয়েন্টলি ই্ম্যাজিনড’ রাষ্ট্র পাকিস্তানে এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ক্রমে প্রকাশ ও প্রকট হতে লাগল। তখন ধর্মের ঘেরাটোপ দিয়ে ওই সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেশিদিন চেপে রাখা সম্ভব হল না। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন-সঞ্জাত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে ভর করে অবশেষে স্বাধীনতা প্রাপ্তি সে ভূখণ্ডের, এই বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতবর্ষের অনেক ঝুঁকি নিয়ে ও ত্যাগ স্বীকার করেও সক্রিয় সহযোগিতায়।

আজ শেখ হাসিনার ভুল বা অন্যায়ের সমালোচনার ছলে অনেকে অস্বীকার করতে চাইছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাঁর আমলে ভারতের আর্থিক সহযোগিতায় সেদেশে ব্যাপক উন্নয়ন— আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক অতীতের ভুমিকার অজুহাতে শেখ মুজিব ও তাঁর নেতৃত্বে ও প্রেরণায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সে দলের অবদান। গত কয়েক দশক ধরেই সেদেশে ধারাবাহিকভাবে ছিল ভারতবিদ্বেষের চোরাস্রোত যা হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে সম্প্রতি সোচ্চার (অপ)প্রচারের মাত্রা পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৫য় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও লেখক আহমদ মুজতাহিদ লিখেছিলেন— জিন্নাহ খেলেছেন মুসলমান কার্ড— কংগ্রেসকে একহাত নেবার জন্য— মিসেস খালেদা জিয়া খেলছেন মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী কার্ড আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে। সে খেলারই হয়তো এক পরিণতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশ।

বস্তুত এক আগ্রাসী মৌলবাদের বিষে জর্জরিত বাংলাদেশে আজ মানবাধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার সবই চরমভাবে ধর্ষিত –বিধ্বস্ত ত্রস্ত বিচারব্যবস্থা। আইন আদালতও পঙ্গু। আদালত চত্বরে আইনজীবীর পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা হুমকি দিচ্ছেন পরিকল্পিত ও অন্যায়ভাবে ধৃত চিন্ময়স্বামীর পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়ালে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে— তাঁর পক্ষের ইতিপূর্বে নিযুক্ত দুই আইনজীবী গুরুতর প্রহৃত— একজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। একজনের চেম্বার আক্রমণ করে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনূস সরকার চায় চিন্ময়স্বামীকে যে করেই হোক জেলের মধ্যে রাখতে। সংখ্যালঘু নিগ্রহের প্রতিবাদে রংপুরে লক্ষা মানুষের বিশাল সমাবেশে তাঁর জোরালো ও দৃপ্ত ভাষণ হয়ত আতঙ্কিত করেছিল চক্রান্ত করে ক্ষমতাসীন হওয়া এই সরকারকে। তাই তাঁর বিনাবিচারে এই দীর্ঘ কারাবাস। অথচ অন্যদিকে পরিবর্তিত এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে অনুমান আশঙ্কা সত্য করে গত ডিসেম্বরের ১ তারিখের আপিল আদালতের রায়ে ২০০৪-এ ঢাকায় ভয়াবহ প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলার মামলায় বিএনপি’র তারেক রহমান (দেশ থেকে পলাতক) এবং লুৎফুজ্জমান বাবর সহ মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্য দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ৪৯ জন আসামীর সকলকে খালাস করে দেওয়া হয়েছে। আবার ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া নৈরাজ্যের সুযোগে জেল থেকে বেরিয়ে পড়া কিছু হার্ডকোর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীও আছে যাদের এখনও ধরা হয়নি।

প্রসঙ্গত ইউনূসের আমলে নিযুক্ত দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ‘কেউ যাতে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে’ বার্তায় আশা জেগেছিল। এভাবে রাজধর্ম পালনের জন্য ইউনূসকে আহ্বান করলেও বাস্তবে চিন্ময়স্বামীর ক্ষেত্রে বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার ও আইনের অধিকার যে কথা সেদেশের বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহারও সম্প্রতি মহম্মদ ইউনূসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তবুও দিন কয় আগে চিন্ময়স্বামীর পক্ষে নতুন করে জামিনের আবেদন করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীন আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ আদালত কক্ষের মধ্যেই গালিগালাজ ও নিগ্রহের সম্মুখীন হন।

বস্তুত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া ড. ইউনূসের অশান্তির ‘শাসন’-এ চরম নৈরাজ্যের বাংলাদেশে তীব্র ভারতবিদ্বেষের আবহে চলছে প্রকাশ্যে যূথবদ্ধ আক্রমণে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হিন্দু নারী নিগ্রহ। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য ঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে মন্দির ভাঙচুর ও ভিন্ন ধর্মালম্বীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা এই প্রথম নয় বিরলও নয়। আটাত্তর বছর আগে লক্ষ্মীপুজোর দিন পরিকল্পনা করেই নোয়াখালিতে মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে প্রায় একমাস ধরে চলা একতরফা গণহত্যার ঘটনা ছিল হয়ত প্রথম ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ৷ তারপর ১৯৫০ থেকে বারংবার পড়শি রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন অজুহাতে একতরফা আক্রমণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, বলপূ্র্বক ধর্মান্তকরণ, অপহরণ ধর্ষণের মত ভয়াবহ ঘটনায়৷ অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে ধর্মীয় সন্ত্রাসের আবহ সৃষ্টি করে, অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পরোক্ষ সহায়তায় বা শাসক দলের স্থানীয় শাখার সক্রিয়তায়, এ গণনিষ্কাসনের মাধ্যমে ‘এথনিক ক্লেনজিং’ এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যপূরণ৷

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন অবস্থার কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন অজুহাতে মাঝেমধ্যেই অত্যচার বন্ধ হয়নি— কখনো বেশি, কখনো কম মাত্রায়। এমনকি শেখ হাসিনার আমলেও ২০২১-এ দুর্গা পুজোর সময় কুমিল্লায় মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সেই একই ধরনের অপকর্ম হয়েছিল। তবে তখন পুলিশ কিছুটা হলেও পদক্ষেপ নিয়েছিল। এখন নৈরাজ্যের বাংলাদেশে যে হিংস্রতা ঘটছে তা সবই লাগামছাড়া— নজিরবিহীন। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে উদারমনা সহমর্মী কিংবা সংস্কতিবান মুসলমানরাও হেনস্থা ও নিগ্রহ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। তবু নোবেলজয়ী ইউনূস বলছেন— ‘সব গল্প উপন্যাস’। এ বড় বিস্ময়ের বেদনার-শঙ্কারও।
পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের দাবির কোনো কোনো সমর্থকরা সে সময় ‘পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয় (বরং) হিন্দু মুসলমান মিলানোর জন্য’ জাতীয় অযৌক্তিক অজুহাত দিলেও এ দাবির পিছনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল তা অনুমান করা যায় সংবাদপত্রে প্রকাশিত ১৯৩৯ এর ২৭ জানুয়ারি সিলেটের এক সভায় ‘ফিলোজফার’ মওলানা আজাদ সোবহানির একটি বক্তব্য থেকে যার ইংরাজী তর্জমা পরবর্তীকালে সন্নিবেশিত হয় আম্বেদকর রচনাবলীতে (Babasaheb Ambedkar Writings and Speeches Vol-8 ‘Pakistan’(first publication 1940) Chapter XII)।

প্রসঙ্গত, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় অনেক খামতি এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক আবহ এখনও বর্তমান। অন্তত তৃতীয় বিশ্বে এমনকি এশিয়ার মধ্যেও ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃষ্টান্ত স্বরূপ। এই গনতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ বিশিষ্ট ভারত ও আজ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্যবস্তু। অনেকেই মনে করেন যে ভারতকে একবার কোনোভাবে কাবু করে ফেলতে পারলে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত প্যান ইসলামিক জঙ্গী গোষ্টির সামনে ফাঁকা মাঠ। অনেকেই হয়ত বিস্মৃত হননি ২০১৬ য় ঢাকার গুলসানে হোলি আরটিজান বেকারিতে আই এস আই এস দ্বারা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি যাতে যুক্তরা অধিকাংশই বাংলাদেশেরই সম্পন্ন ঘরের এবং তারা কেবলমাত্র ধর্মীয় উন্মাদনাতেই ওই কাজে লিপ্ত বলে জানা গিয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেরই আশঙ্কা পড়শি দেশটি কি তবে আরেকটি আফগানিস্তান হতে যাচ্ছে। ২০০৫-এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ— দ্য নেক্সট আফগানিস্তান’ গ্রন্থে হিরন্ময় কারলেকর সেরকমই অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ছলে বলে কৌশলে এক চরম মৌলবাদী অপশক্তির সম্প্রতি ক্ষমতাসীন হওয়ায় এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির এক নেতিবাচক পরিবর্তনের আশংকাই– এই ‘বিজয় দিবসে’ ঘরে বাইরে দুঃশ্চিন্তা।