• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

বইপ্রেমীরাই কি এখন ফেসবুকের নেশায় বইকেই ভুলে যাচ্ছে

একসময় গিরিশচন্দ্র ঘোষ দর্শকের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রচুর নাটক লিখে মঞ্চসফল হয়েছিলেন। সেই নাটকগুলি তাঁর মৃত্যুর পরেই বিস্মৃত হয়ে যায়। তাই অসুস্থ খবরখাদকের জীবনে বিশ্ব বই দিবসের কোনো প্রভাব পড়ে না।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

শীত পরশ পেতেই হরেক মেলার আয়োজন বার্তা হাতছানি দিয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে বইমেলার বিস্তারে তার পার্বণী উৎসবের ঘটা বইপ্রেমীদের মনে বসন্ত নিয়ে আসে। অথচ তার মধ্যেই ‘এখন আর কেউ বই পড়ে না’ ধারণা যেন বৈধতা লাভ করেছে। সোস্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে বই পড়ার অভ্যাসটাই যেন ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। সেখানে স্মার্ট ফোনের দৌলতে আঁধারেও পাঠকের চোখের পলক পড়ে না, রাতেও তার অবিরত অতৃপ্তির নেশায় বুঁদ হয়ে জেগে থাকার আয়োজন চলে। সেখানে বুকের কাছেই ফেসবুকের অবিরত হাতছানি। অথচ প্রতিবছর ২৩ এপ্রিলের বিশ্ব বই দিবস পালন করার রীতি চলে আসছে। এখন তাও ফেসবুকে জন্মদিন পালনের মতো বিশ্ব বই দিবসও স্মরণ করা হয়। বই পড়ার বিষয়টিই যেন সেকেলে আভিজাত্যে স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে উঠেছে । অথচ বিশ্ব বই দিবস পালনের মধ্যেও বাঙালির আভিজাত্য বোধ এই সেদিনও সমীহ আদায় করে নিত। বিশ্বের কিংবদন্তী সাহিত্যস্রষ্টা শেক্সপীয়ারের জন্ম (১৫৬৪) এবং মৃত্যুও (১৬১৬) হয়েছিল ২৩ এপ্রিল । সেখানে স্মরণে বরণীয় ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনে আলাদা মাত্রার ঐতিহ্য সংযোজিত হয়। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে সর্বাধিক জনপ্রিয় শব্দের একটি হল ‘বই’। শব্দের সঙ্গে অর্থের যেমন, শিক্ষার সঙ্গে বইয়ের তেমন হরগৌরীয় সুসম্পর্ক। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের সহজতর মাধ্যম হল বইপড়া। আজও তার বিকল্প নেই। শুধু ‘আধুনিকযুগেই নয়, প্রাচীনকালেও বইয়ের আভিজাত্যে টান পড়েনি। ‘আমাদের শিক্ষা’ গ্রন্থের ‘বইপড়া’ (‘সবুজ পত্র’, শ্রাবণ ১৩২৫) প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরি ন্যায়দর্শনের ‘সর্বশ্রেষ্ট ভাষ্যকার’ বাৎসায়নের কামসূত্রে প্রাচীন ভারতবর্ষের নাগরিক সভ্যতার হাল আমলের বই পড়ার হদিস দিয়েছেন। আবার ইন্টারনেটের যুগে সস্তা জনপ্রিয় গণমাধ্যমের রঙিন হাতছানিকে উপেক্ষা করেও বইয়ের অপরিহার্যতার বিকল্পের যথার্থ সন্ধান এখনও মেলেনি। মুদ্রাযন্ত্রের আবিষ্কাবের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়-আঙ্গিকে বইয়ের বৈচিত্রময় উপস্থিতি শুধুমাত্র শিক্ষা দীক্ষায় সীমায়িত নয়, চলিষ্ণু জীবনের পাঠশালায় সর্বদাই তার প্রাণখোলা আনাগোনা। উপস্থাপিত বিদায়ের পরিধির আধিক্যে ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত নামকরণের প্রবণতায় বইয়ের যথার্থ সংজ্ঞা দেওয়ার প্রচেষ্টা সহজসাধ্য নয়। তাই মুদ্রিত পৃষ্ঠার একসূত্রে আবদ্ধ অর্থে বইয়ের রকমারি ব্যবহার অর্থাৎ নোটবই থেকে চেকবই (একালের জনপ্রিয় সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকও) সবই দৈনন্দিন জীবনের ছকে বাঁধা বুলির নামান্তর।

বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় কালদর্পিত ভোগবাদী সমাজে ব্যস্ততম জীবনযাত্রার রকমারি রঙিনপত্র পত্রিকায় চাহিদা যোগানের ভারসাম্য বই ও অ-বইয়ের পার্থক্য নিরূপণ বাতুলতা মাত্র। ভক্তির পরকাষ্ঠায় যেমন ধর্মগ্রন্থাদি শালু কাপড়ে আবদ্ধ থাকে আবার আভিজাত্যের মোড়কে অথবা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সদিচ্ছায় তেমনই শো-কেসে বা আলমারিতে শোভাবর্ধন করে ধ্রুপদী সাহিত্য। নিঃসঙ্গ মানুষের অন্তরঙ্গ বন্ধু, পথ প্রদর্শক, জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার, মানসিক ক্ষুধার অমৃত আহার, জীবনযুদ্ধের ইতিহাস, আনন্দের খনি, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অনুসন্ধানকেন্দ্র, সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার ছক, অনুভূতির অমৃতের আশ্রয়স্থল ইত্যাদি যে নামেই বইকে বিভূষিত করি না কেন, তাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল’ বাঁধানো অবস্থায় ‘ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া’ থাকা নীরব মহাশব্দের সঙ্গে লাইব্রেরিকে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ বই হল সমুদ্রের তলদেশের নীরব মহাশব্দের প্রশান্ত তরঙ্গবিশেষ। আবার প্রমথ চৌধুরী পূর্বোক্ত প্রবন্ধে লাইব্রেরিকে মানসিক হাসপাতাল বলে তাকে স্কুল কলেজের চেয়েও উচ্চস্থানে বসিয়েছেন।

যুগরুচির ও প্রযোজনের ভিত্তিতে লাইব্রেবিতে পাঠকের টান পড়াকে বই পড়া না-পড়ার বিষয়টির সঙ্গে বইয়ের প্রতি আমজনতার আকর্ষণহীনতার কারণও আলোচনায় উঠে আসে । সমাজের বহু মানুষ এখন অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জমান। অর্থনৈতিক দৈন্যে নিষ্পেষিত। তাই বিশ্ব বই দিবস শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ক্ষীণভাবে দায়সারা গোছের চর্চিত বিষয় হিসাবে আজও প্রতীয়মান হচ্ছে। বইমেলার বহর বাড়লেও মেলা বই পড়ার অবসর বেশিরভাগ কর্মব্যস্ত মানুষেরই মেলে না। তাই বইপ্রাণ মানুষের এই স্মরণীয় দিনটির আবেগের বেগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু ‘উত্তরতিরিশ’- এর ‘পড়া’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, বই যে আমাদের জীবনে এতবড় জায়গা জুড়ে আছে, তার কারণই তা আমাদের আনন্দ দেয় এবং সেই সঙ্গে জীবন সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত করে, প্রতিদিনের জীবনকে সুন্দর করে, ভালো করে বাঁচতে শেখায়। ভালো করে বাঁচাটাই আমাদের উদ্দেশ্য, বই তার অন্যতম উপায় মাত্র। কিন্তু সেই উপায়টি আজও মানুষের সম্বল হয়ে উঠল না।

বর্তমানে একটি আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করা যায়, বইপড়া কমলেও এখন আগের থেকে পত্রপত্রিকা বিশেষকরে খবরের কাগজ পড়ার বহর বেড়েই চলেছে। একেকজন খবরখাদকের এতই নেশা যে, একই দিনে একাধিক খবরের কাগজ পড়ে থাকেন। ফলে তাঁদের বইয়ের পাতা উল্টালেই ঘুম এসে যায়। পত্রপত্রিকার কর্মকর্তারাও এই খবরখাদকের রসদের ভাঁড়ারটি বেশ উপাদেয় করে সাজিয়ে তোলেন। সেজন্য অধিকাংশ পত্রপত্রিকারই লক্ষ্যে থাকে পাঠক কোন খবরটা খাবে বেশি। সেই ধরনের খবরই ছাপা হয় সেই পত্রপত্রিকায়। অর্থাৎ অধিকাংশ খবরের কাগজের খবরে সামাজিক দায়ের চেয়ে বিক্রি ও বিজ্ঞাপনের দায়টাই বড় হয়ে উঠেছে। ফলে এখনকার খবরের চমকে চুমুক দিয়ে খবরখাদকের তৃষ্ণা যেমন বেড়ে চলে, তেমনই রসনা পরিতৃপ্তি করতে গিয়ে হজমের যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়ে। তারফলে মননের ক্ষুধা হয় মরে যায়, নয়তো গলাধঃকরণের পর হজম হয় না। এজন্য খবরখাদকদের বইপড়া আর হয়ে ওঠে না। একসময় হয়তো এমন হয়ে যাবে যখন বইও সেই খবরের চমকের বিষয় ও ভাষায় লেখা হবে। এখন তো বলা হচ্ছে, পাঠকের দিকে লক্ষ রেখে বই লিখতে হবে। এই কথাটিই অবইসুলভ। আজ পর্যন্ত কোনো ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠকের অভিরুচিকে লক্ষ করে লেখা হয়নি।

লেখক পাঠক চায়, তার মানে এই নয় যে পাঠকের মনের মতো করে লেখককে লিখতে হবে। লেখক তাঁর মনের তাগিদে লিখবেন এবং পাঠকের মনে সেই তাগিদের উপযোগিতা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরবেন। আর তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পাঠকের মনের খোরাকের চাহিদা মাফিক লিখতে গেলেই বইয়ের পসার হয়তো বাড়বে কিন্তু বইয়ের চিরন্তন সমাদর হারিয়ে যাবে। একসময় গিরিশচন্দ্র ঘোষ দর্শকের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রচুর নাটক লিখে মঞ্চসফল হয়েছিলেন। সেই নাটকগুলি তাঁর মৃত্যুর পরেই বিস্মৃত হয়ে যায়। তাই অসুস্থ খবরখাদকের জীবনে বিশ্ব বই দিবসের কোনো প্রভাব পড়ে না। ভোগবাদী জীবনে খবরে কাগজ বা রঙিন পত্রপত্রিকা ভোগের সহায়ক, সেক্ষেত্রে বই তো ভোগের অন্তরায়। তার উপর ছাত্রজীবনে দায়ে পড়ে দারপরিগ্রহের মতো বছর বছর গাদাগাদা নোট-বই পড়ার হ্যাপা পোয়ানো থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বইপড়ার স্বাদটাই হারিয়ে যায়। তাই এখন কেউ বই পড়ছে শুনলেই অনেকের মনে ছাত্রছাত্র ভাবের উদয় হয়। অর্থাৎ এখনও বইপড়া ছাত্রজীবনেই আটকে আছে। সে বন্ধন শিথিল হওয়ার চেয়ে এখন যেন আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে।

কোকিলকে বলা হয় বসন্ত-সখা। তাহলে পাঠককে কী বই-সখা বলা যেতে পারে? পারে না। পাঠকের বৈচিত্র আছে, কোকিলের কুহুতে ভেদ নেই। ফলে পাঠক বই-সখা বা বই-সই হয়েও উঠেনি। আবার বই বৈষয়িক সম্পদও নয়। ফলে পাঠকের খাসতালুকে বই হয় অতিযত্নের সংরক্ষণে অকেজো হয়ে রয়েছে, নয় অবহেলার শিকার হয়ে ধূলায় মলিন হয়ে উঠেছে। তাই বিশ্ব বই দিবসের আলোয় বই ও পাঠকের হরগৌরীসুলভ মিলনদৃশ্যটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। তারচেয়ে রঙিন গণমাধ্যমের আকর্ষণে আবাল-বৃদ্ধ- বণিতার ছবিটা বেশ সমুজ্জ্বল। প্রমথ চৌধুরী শিল্প-সাহিত্যের গণতন্ত্রীকরণের প্রতি খেদ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, শিল্প-সাহিত্যের গণতন্ত্রীকরণের পাশাপাশি আশ্চর্যজনকভাবে বইপড়ায় গণতান্ত্রিকতা লক্ষ করা যায় না। যেভাবে অনেকের মধ্যে শিল্পী-সাহিত্যিক হওয়ার জোয়ার এসেছে, সেভাবে বইপ্রেমীর সংখ্যা বাড়েনি। অথচ বইয়ের সুস্থজীবনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে অসুস্থ খবরখাদকদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাই বিশ্ব বই দিবসের ‘আলো বইয়ের ঘরে পৌঁছাতে পারে না। যদি পারত, তাহলেই বুকের (Book-এরও) যথার্থ স্থান হতো বই-এ। তার বদলে একালে নখদর্পণে বিশ্বদর্শনের মতো আঙুলের ডোগায় ফেসবুকের সহজ,সুলভ ও চিত্তাকর্ষক বর্ণরঙিন আলোর হাতছানিতে বইয়ের পাঠকের ঠাঁই নেওয়াটা অস্বাভাবিক নয় ! কেননা ফেসবুকের অবারিত দ্বার, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ও ছড়িয়ে দেওয়ার অনন্ত হাতছানি বইয়ের সচেতন পাঠককেও মোহাচ্ছন্ন করে তোলে!