• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

কুম্ভীরাশ্রু

২০০২ সালে গুজরাতে হিন্দুত্ববাদী হামলার সময় ধর্ষণের শিকার হন বিলকিস বানো।

নারী নির্যাতনের ঘটনায় ‘দুঃখিত’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘দ্রুত বিচার’ চাইলেন দেশের আদালতগুলির কাছে। দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের উপস্থিতিতে মোদি বলেন, ‘সমাজে নারীদের ওপর অত্যাচার এবং শিশু সুরক্ষার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। মহিলাদের ওপর হিংসা মামলাগুলিতে যত দ্রুত বিচার দেওয়া যাবে, তাঁদের নিরাপত্তা ততোই নিশ্চিত হবে।’

নারী ও শিশু সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী মোদির এই প্রকাশ্য উদ্বেগ আসলে ‘কুম্ভীরাশ্রু’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতোই এই প্রশ্ন তুলেছেন মহিলা আন্দোলনের কর্মীরা। বিজেপি-শাসিত মণিপুর থেকে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও-হাথরসে ভয়ঙ্কর নারী নির্যাতন, জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায় নাবালিকা ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সময়ও নীরব ছিলেন মোদি। গুজরাতে বিলকিস বানোকে ধর্ষণের পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা, মহিলা কুস্তিগীরদের ওপর বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণের লাগাতার যৌন হেনস্তা থেকে স্বঘোষিত ‘ধর্মগুরু’ আশারাম বাপু ও রাম-রহিমদের যথেচ্ছ নারী নির্যাতন—কোনও ক্ষেত্রেই নির্যাতিতাদের সম্মান রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে। এমনকী হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে মুখও খোলেননি তিনি। অথচ এখন হঠাৎ করে নারী নির্যাতন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন মোদি।

কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে গত ৯ আগস্ট তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে প্রবল আন্দোলন ওঠার পর থেকে এই নিয়ে পরপর তিনবার মুখ খুলতে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীকে। এর মধ্যেই বিজেপি-জোট শাসিত মহারাষ্ট্রের বদলাপুরে গত ১২ এবং ১৩ আগস্ট পরপর দু’দিন এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দুই শিশুকে যৌন নির্যাতনের ঘটনাতেও রাস্তায় নেমে এসেছিলেন অসংখ্য মানুষ। রেললাইন অবরোধ থেকে শুরু করে অভিযুক্ত স্কুলটিতে বেপরোয়া ভাঙচুরও চালায় ক্ষুব্ধ জনতা। দু’টি ক্ষেত্রেই অপরাধীদের আড়াল করতে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জোরালো অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তারপরই নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদে মানুষকে সংগঠিতভাবে রাস্তায় নামতে দেখে এখন প্রকাশ্যে ‘কুম্ভীরাশ্রু’ বিসর্জন করে চলেছেন মোদি।

দিল্লিতে জেলা বিচারালয় সম্মেলনে হাজির বিচারকদের অনেকটা পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে মোদি বলেন, ‘নারী নির্যাতনে জড়িত অপরাধীদের যত দ্রুত শাস্তি দেওয়া যাবে, ততই সুরক্ষা নিয়ে বেশি বেশি আশ্বাস পাবেন মহিলারা। বিচার-ব্যবস্থা হল সংবিধানের রক্ষক। সুপ্রিম কোর্ট এবং বিচারব্যবস্থাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এদেশের মানুষ কখনই সুপ্রিম কোর্ট এবং বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায়নি।’ ৩১ আগস্ট এই ভাষণ দেওয়ার আগে গত ১৫ আগস্ট লালেকেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি দেশে ‘মা-বোনেদের ওপর অত্যাচার’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তারপরেই ২৫ আগস্ট মহারাষ্ট্রের জলগাঁওয়ের এক অনুষ্ঠানে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধকে ‘ক্ষমার অযোগ্য পাপ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

গত পনেরো দিনে পরপর তিনবার মোদির এইরকম ‘অমৃতবচন’ শুনে অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মোদির দশ বছরের শাসনে দেশে মহিলা নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাতেই বিজেপি দলের অপরাধী নেতাদের বাঁচাতে তৎপরতা দেখিয়েছে প্রশাসন, হেনস্থার শিকার হয়েছেন যাঁরা, ন্যায়বিচার মেলেনি তাঁদের। যাবতীয় বর্বরতা দেখেও নীরব থেকে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, পরোক্ষে মদত জুগিয়েছেন অপরাধীদের।

উল্লেখ্য, ২০০২ সালে গুজরাতে হিন্দুত্ববাদী হামলার সময় ধর্ষণের শিকার হন বিলকিস বানো। দীর্ঘ টালবাহানার পর সাজা হয় দোষী ১১ জনের। বিজেপি-শাসিত গুজরাত সরকারের কৌশলে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে মুক্তি পেয়ে যায় দোষী। জেল থেকে বেরনোর পর প্রকাশ্যেই এই ধর্ষকদের রীতিমতো মালা পরিয়ে সম্বর্ধনা দেয় হিন্দুত্ববাদীরা। এই ঘটনায় সারা দেশ হতবাক হলেও প্রধানমন্ত্রী মোদি ছিলেন একেবারে চুপ।

জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়াতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এক মুসলিম নাবালিকাকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর খুন করে ৭ হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতী। ধৃত ধর্ষকদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে বিজেপি। এই ঘটনায় সারা বিশ্বে বিক্ষোভ দেখা দিলেও প্রধানমন্ত্রী মোদি ছিলেন নিশ্চুপ।

বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে ২০১৭ সালের ৪ জুন এক নাবালিকাকে দলবদ্ধ হয়ে ধর্ষণ করেছিল বিজেপির তৎকালীন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার ও তাঁর অনুগামীরা। নির্যাতিতার বাবা এবং তাঁর পরিবারের সকলকেই খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা। তখনও প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘রা’ ছিল না।

বিজেপি-শাসিত আরেক রাজ্য মণিপুরে শাসক মদতে লাগাতার হিংসা চলছে। চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে কুকি সম্প্রদায়ের দু’জন মহিলাকে নগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটানোর মতো বর্বরতার ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছিল দেশ। সারা দেশ দাবি তুললেও এখনও মণিপুরে যাননি প্রধানমন্ত্রী মোদি। মোদির আচরণ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগ্রহ রুখতে দেশজুড়ে সুসংহত আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে মোদি সরকারের অনীহা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এখন নারী নির্যাতন নিয়ে মোদির উদ্বেগ প্রকাশ নিছক ‘কুম্ভীরাশ্রু’ ছাড়া আর কিছু নয় বলে সকলেই মনে করেন।