শোভনলাল চক্রবর্তী
‘অপরাজিতা’ বিল পাস হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায়। একথা ঠিক যে ন্যায় বিচারের পরিকাঠামো তৈরি না করে কেবলই ধর্ষণে অভিযুক্তের আরও কঠোর সাজা দাবি করা অর্থহীন। অথচ, সেই প্রাথমিক কাজে ফাঁক থেকে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে ফাস্ট ট্র্যাক আদালত, এবং বিশেষ ভাবে শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের (পকসো) বিচারের জন্য বিশেষ আদালত নির্মাণের কাজ শুরু হয়। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের নির্দেশ ছিল, ২০১৫-২০ সালের মধ্যে সারা দেশে আঠারোশো ফাস্ট ট্র্যাক আদালত তৈরি করবে রাজ্যগুলি, হাই কোর্টের পরামর্শ নিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকার এ জন্য নির্ভয়া তহবিল থেকে কিছু বরাদ্দও করেছিল। এই প্রকল্পের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত নির্মাণ ধার্য করা হয়েছিল, যার মধ্যে ধার্য ছিল কেবল পকসো মামলাগুলির জন্য কুড়িটি বিশেষ আদালত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পে যোগদানের সম্মতি দিয়ে কেন্দ্রকে প্রথম চিঠি পাঠায় গত বছর, কেবলমাত্র সাতটি পকসো আদালত শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সংশোধিত লক্ষ্য অনুসারে রাজ্যকে ১৭টি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত মঞ্জুর করা হলেও, এ বছর জুন মাস পর্যন্ত কেবল ছ’টি পকসো আদালত শুরু হয়েছে, আরও এগারোটির কাজ শুরুই হয়নি।
ধর্ষণ ও পকসো মামলা মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আটচল্লিশ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ কথাও ভোলা চলে না যে, যে কোনও রাজ্যের মতো, এখানেও প্রকৃতপক্ষে যত নিগ্রহ ঘটে, তার অতি সামান্যই পুলিশের খাতায় লেখা হয়। আইন প্রণয়নের দশ বছর পরেও অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে এখনও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি তৈরি হয়নি। যেখানে হয়েছে সেখানেও প্রায়ই তা রয়েছে খাতায়-কলমে। অসংগঠিত মহিলাদের জন্য জেলায় জেলায় গঠিত ‘লোকাল কমিটি’র অবস্থাও তথৈবচ। মহিলা থানা, মহিলা আদালতগুলির কার্যকারিতা কতখানি, তার মূল্যায়ন হয়নি। কর্মরত মহিলাদের হস্টেল, জরুরি প্রয়োজনে রাতে থাকার মতো আবাস, নিগৃহীত মহিলাদের সহায়তা, এ সব ব্যবস্থার সামান্যই হয়েছে। অপরাধ প্রতিরোধে এত ফাঁক রেখে দ্রুত বিচার, কঠোর শাস্তির দাবি গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার শামিল।বার বার তাগাদা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার মহিলাদের সহায়তার জন্য নিবেদিত বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর (১৮১) চালু করেনি। মহিলা ও শিশুদের উপর নির্যাতনের প্রতিকারে বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক আদালত শুরু করেছে অনেক বিলম্বে, অতি অল্প সংখ্যায়।
কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের এই তথ্যগুলি উদ্বেগজনক। আর জি কর-কাণ্ডের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী যে আরও কঠোর আইন ও কঠিন শাস্তির দাবি তুলছেন, তা কি এই বিচ্যুতিগুলি থেকে নজর ঘোরাতে? সেই ভাবনা থেকেই কি অপরাজিতা বিল? প্রশ্ন আছে। আশা রাখি যে যথাসময়ে সে সব আমরা জানতে পারব।আইন কঠোর করার প্রস্তাব দিয়ে যে চিঠি মমতা কেন্দ্রকে পাঠিয়েছিলেন, তার জবাবি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, যৌন হিংসা প্রতিরোধের পরিকাঠামো নির্মাণে পশ্চিমবঙ্গের বিলম্ব ও বিচ্যুতি, দু’টিই ঘটেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রাণদণ্ডের মতো তীব্র শাস্তির ব্যবস্থা ধর্ষকদের প্রতিহত করবে, এমন আশা করা সমীচীন নয়। যা অপরাধের প্রবণতা কমায়, তা হল পুলিশের তৎপরতা, শাস্তির নিশ্চয়তা। মেয়েদের অভিযোগকে গুরুত্ব দান, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলির নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, ধর্ষণের যথাযথ তদন্ত এবং আদালতের দ্রুত বিচার— এগুলিই দুষ্কৃতীদের সংযত হতে বাধ্য করে। সর্বাধিক জরুরি অপরাধীকে নিবৃত্ত করা। তার জন্য পুলিশ, প্রশাসন ও অসরকারি নানা পরিষেবার একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। যথাযথ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, তার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ, এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগ করা প্রয়োজন। এটাই সরকারের কাজ। অপরাধীর কত দিনের মধ্যে সাজা হওয়া দরকার, কী সাজা হওয়া দরকার, তা নির্ধারণ করার আইন রয়েছে, আদালতের প্রজ্ঞাও রয়েছে। আইনে ঘাটতি নেই, ঘাটতি পরিকাঠামোর।ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির নিরিখে সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গকে মহিলাদের পক্ষে বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক বলা মুশকিল।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (২০২২)-র পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় যেখানে ৪.৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হার ২.৩। রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই হার পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েক গুণ। অন্তত ২০ লক্ষ মানুষ বাস করেন, দেশের এমন ১৯টি শহরের মধ্যে ২০২২ সালে প্রতি এক লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছিল কলকাতাতেই— ০.২টি। সর্বভারতীয় গড় ৬.৭; রাজস্থানের জয়পুরে এই হার ছিল ৩৪.২, দেশের রাজধানী দিল্লিতে ১৫.৯, এমনকি মহিলাদের পক্ষে নিরাপদ শহর হিসাবে পরিচিত মুম্বইয়েও এই হার ছিল ৪.৩। সংঘটিত ধর্ষণের একটি অংশের কথা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয় না, এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখলেও পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতাকে দেশের অন্য রাজ্য বা মহানগরের তুলনায় অ-নিরাপদ বলা যায় না। এই পরিসংখ্যান যেমন আর জি কর-কাণ্ডের ভয়াবহতাকে তিলমাত্র হ্রাস করে না, আবার একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা বহুআলোচিত হলেই, বা তাকে কেন্দ্র করে বিপুল জনআন্দোলন গড়ে উঠলেই তা রাজ্যের প্রকৃত ছবিটিকে পাল্টে দিতে পারে না। গোটা আলোচনাটিই রাজনৈতিক চাপান-উতোরে পর্যবসিত হলে এই ছবিগুলি চোখ এড়িয়ে যেতে থাকে। যেমন, রাষ্ট্রপতি আর জি কর-কাণ্ডে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সম্ভবত পরিস্থিতির উত্তাপেই বৃহত্তর ছবিটির কথা বিস্মৃত হয়েছেন।
ভারতের দুর্ভাগ্য, এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও, এমন একটি গুরুতর বিষয় নিয়েও শুধু রাজনীতিই চলে। অন্যত্র ধর্ষকদের জয়মাল্যে বরণ করে নেওয়া বিজেপি যেমন পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে রণোন্মত্ত, তেমনই বঙ্গীয় শাসককুলও কেবলই দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত। তার চেয়ে, সব পক্ষই যদি বৃহত্তর ছবিটির দিকে নজর রেখে সার্বিক সমাধানের পথ সন্ধান করত, যদি অন্তত একটি বারের জন্য রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারত, তা হলে হয়তো পরিস্থিতি খানিক হলেও পাল্টাত। কিন্তু, এ পোড়া দেশে তেমন আশা করার সাহস বুঝি কারও নেই। আর জি কর-কাণ্ডের নিন্দা করলেই বঙ্গীয় শাসককুল তারস্বরে বলে চলেছেন, এই অগস্ট মাসেই দেশ জুড়ে আরও অজস্র ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ভাবখানা এমন, যেন দেশের অন্যত্রও একই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া এই নারকীয় কাণ্ডের ভয়াবহতা বা গুরুত্ব তিলমাত্র হ্রাস পায়! তবে, অস্বীকার করা যাবে না যে, সত্যই বিভিন্ন রাজ্যে ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা। আক্রান্তদের মধ্যে সত্তর অতিক্রান্ত বৃদ্ধা আছেন, তিন বছরের শিশুকন্যা আছে; নার্স আছেন, স্কুলছাত্রী আছে। নিদেনপক্ষে একটিও ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়নি, এমন এক দিনের সংবাদপত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এবং, শুধু অগস্ট মাসের কথা নয়, ভারতে ধর্ষণ একেবারে জলভাত হয়ে উঠেছে বেশ কিছু বছর ধরেই।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের চূড়ামাত্র— সামাজিক গ্লানি, পারিবারিক বাধার মতো হরেক কারণে দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের একটি বড় অংশের খবর থানা অবধি পৌঁছয় না। স্পষ্টতই ধর্ষণ কোনও একটি শহরের, কোনও একটি রাজ্যের বা কোনও একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সমস্যা নয়— এটি এক সর্বভারতীয় সমস্যা। রাজ্যে রাজ্যে অবশ্যই অপরাধের সংখ্যার তারতম্য রয়েছে, কিন্তু এটাও সত্য যে, ভারতের কোনও রাজ্যেই মহিলারা সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করতে পারেন না। এ ভারতের জাতীয় লজ্জা— তাকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করলে মূল প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।বিল এসে কি হবে যদি ন্যায় বিচার রয়ে যায় অধরা?