• facebook
  • twitter
Thursday, 19 December, 2024

বাংলাদেশের মৌলবাদীদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারত বিদ্বেষই একমাত্র পুঁজি

আসলে যার যত কম শক্তি, তার তত বেশি শক্তির আস্ফালন। এই আস্ফালনে শক্তি জাহিরের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব সংকট। ভারতের শক্তিতে ভর করেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের উপরে মৌলবাদীদের নৃশংসতা চরম আকার লাভ করা নিয়ে তীব্র বাদপ্রতিবাদের মধ্যেই যুদ্ধের দামামা যেন বেজে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তান জন্ম থেকেই ভারতবিদ্বেষী। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠলেও পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীদের সেই ভারতবিদ্বেষ ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের চাপে পড়লেও তার অস্তিত্ব বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে জারি ছিল। সে দেশের রাজনৈতিক দলের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, ভারত বিরোধিতাই সে দেশের দেশপ্রেমের পরিচয়ে তীব্রতা লাভ করে। চব্বিশের অভ্যুত্থানে সেই ভারতবিদ্বেষী মনোভাবই প্রকট হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই সে দেশের মৌলবাদী চেতনায় ক্ষমতা দখলের রণহুঙ্কার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এবছর জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকেই চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের অছিলায় হাসিনা সরকারের উৎখাতে জারি হওয়া আন্দোলন থেকেই ইতিপূর্বের ভারতবিরোধিতা ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে।

সেক্ষেত্রে সে দেশের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের প্রতি দেশভাগের পর থেকে ধারাবাহিক বিদ্বেষী মনোভাব সেই অবকাশে প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকট হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিকভাবেই তা ভারতবিরোধিতার সঙ্গে জুড়ে যায়। সেদিক থেকে ৫ আগস্টে পরিকল্পিত গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের উৎখাতের সাফল্যে সেই ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাবই প্রাধান্য লাভ করে। সেক্ষেত্রে উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার আশ্রয় দেওয়ায় সে দেশের মৌলবাদীদের ভারতবিরোধী হিন্দুবিদ্বেষকে পুঁজি করে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে ভারতের বিরোধিতা থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্বিচারে নৃশংস নিপীড়ন করাই সে দেশে দেশপ্রেমের পরিচয় মনে হয়। এজন্য পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীদের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের মধ্যে একদিকে দেশের জনমানসে ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস, অন্যদিকে নিজেদের অস্তিত্ব জাহিরের আয়োজন।

সেখানে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্বিচারে বর্বরোচিত আক্রমণে বিশেষ সাফল্য না মিললেও দেশবাসীর একচ্ছত্র সমর্থন থেকে উল্টে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার চাপে স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহি মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে মৌলবাদীদের দিশাহীন ভারতবিদ্বেষ হিন্দু থেকে হিন্দুস্তানের দিকে লক্ষ্যভেদী উগ্রতায় ছুটে চলেছে। সে দেশে গণঅভ্যুত্থানের পর বাঙালি হিন্দুদের উপরে নেমে আসা আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের মধ্যে মৌলবাদীরা শুধু ধর্মীয় অধিকার দেখেনি, তার নেপথ্যে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের ভয়ও তাদের মনে জেগে উঠেছিল। এজন্য ইস্কনের সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ই সেখানে প্রাধান্য পায়নি, তার মধ্যে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের চেতনাও সংযুক্ত রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে সে দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতিবাদী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে চিন্ময়কৃষ্ণের প্রতি বাংলাদেশের মৌলবাদী সমর্থনপুষ্ট সরকারের শত্রুভাবাপন্নতাই স্বাভাবিক।

আসলে যার যত কম শক্তি, তার তত বেশি শক্তির আস্ফালন। এই আস্ফালনে শক্তি জাহিরের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব সংকট। ভারতের শক্তিতে ভর করেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেয়েও ভারতের কাছে পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে। সেক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যপুষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের মধ্যে সে দেশের পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীদের কাছে ভারতের আধিপত্যকামী চেতনাতেই তাদের অভ্যুত্থানের মধ্যেও পরাধীনতার গ্লানিবোধ জেগে ওঠে, সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি নৃশংস প্রতিশোধ নিয়েও তা তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না। সেখানে তারা ভারতের আক্রমণের কোনওরকম খবর না থাকা সত্ত্বেও বিনা প্ররোচনায় স্বরচিত কল্পনায় ভর করে যুদ্ধ জয়ের আস্ফালনে মেতে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে কল্পনার লাগামহীন বিস্তার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এজন্য চারদিনে কলকাতা দখল থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশ্যার আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন মুখে চলে আসে। শুধু তাই নয়, উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে নিয়ে বাংলাদেশ বিস্তারের পরিকল্পনাও সামনে চলে আসে। ব্যাপারটা এমনই অদ্ভুত যে, সুকুমার রায়ের ভাষায় ছিল বিড়াল, হয়ে গেল রুমাল। সে দেশের সংখ্যালঘুদের নির্বিচারে নৃশংস দমনপীড়নের প্রতিবাদে এপার বাংলার যখন বাঙালি হিন্দুদের প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে, তখন তার পাল্টা হিসেবে আগুনে ঘৃতাহুতির মতো যেন ধর্মীয় বিদ্বেষের মুখে ক্ষমতা জাহিরের বুলি বুলেটে পরিণত হচ্ছে। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতও কোনওরকম রাখঢাক না করে মৌলবাদীদের সঙ্গে সোচ্চার হয়ে উঠেছে ।

শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টে পরিবর্তিত সরকার যে আগের সরকারের মতো দুর্বল নয়, অনেক বেশি শক্তিশালী, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। একটার মৃত্যু হলে আগে চারটির পরিবর্তে এখন চল্লিশ জনের রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রদর্শনী বলিষ্ঠ চেতনায় যুদ্ধং দেহি মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। অথচ বাংলাদেশের নির্বিচারে নিপীড়িত বাঙালি হিন্দুদের ভয়ঙ্কর দশার কথা জেনেও ভারত সরকারের নীরবতার বিরুদ্ধেই বিশেষ করে এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুর প্রতিবাদ গর্জে উঠেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের কথা শুনে ভারতের সে দেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সক্রিয়তাও লক্ষ করা যায়। সেখানে কত সহজে, কত অল্প সময়ে বাংলাদেশকে পরাজিত করা যায়, তার প্রতিযোগিতা চলছে। শুধু তাই নয়, চ্যানেলে চ্যানেলে দুই দেশের সমরাস্ত্র ও সৈন্যের সংখ্যা দিয়ে তুলনা করে সেই তাচ্ছিল্য আরও প্রকট করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সৈন্যরাই যুদ্ধ করে, দেশবাসীরা নীরবে দেখে। আসল যুদ্ধ তো হয় দেশবাসীদের মধ্যে। সেক্ষেত্রে মৌলবাদী ধর্মান্ধতার শিকারে দেশবাসীর ট্র্যাজিক পরিণতি কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়।
ভারত চিরকাল যুদ্ধবিরোধী শান্তির দেশ। যুদ্ধকে এড়িয়ে চলার পক্ষে তার আদর্শ অন্য দেশের কাছেও পাথেয়।

আত্মরক্ষার জন্য তার যুদ্ধের আয়োজন। শুধু তাই নয়, এজন্য প্রতিবেশী দেশের পাশে দাঁড়ানোতেও তার নজির বর্তমান। স্বাধীন বাংলাদেশ তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই দেশই আজ ভারতের সঙ্গে শুধু যুদ্ধ লিপ্ত হতে চায় না, তার দেহাংশ দখল করতেও চায়, ভাবা যায়! অথচ যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার বা ক্ষমতা দখলে ভারত বরাবরই অহিংস নীতি মেনে চলেছে। ভারত যে ধর্মেরও দেশ। মানুষের ধর্মে তার অগাধ বিশ্বাস। মানুষের ধর্মের বিস্তার মানুষকে ভালোবাসায়, তাকে আপন করে নেওয়ায়। সবাইকে আপন করেই ভারতের মহাভারতের বিস্তার। সেখানে সহাবস্থানের মহত্ত্ব, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের গৌরব। ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়েও তার মানবিক অস্তিত্ব তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তার পরিচয়কেই সমুন্নত করেছে। সেখানে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের সংখ্যালঘু বিদ্বেষই বলে দেয় তারা মানববিদ্বেষীও।

মানুষের চেয়ে তাদের কাছে ধর্ম বড় হয়ে উঠেছে। অথচ সে ধর্ম ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বিপক্ষের মানুষকে শত্রু বলে চিহ্নিত করে প্রতিশোধের আগুনে পোড়ায়, অন্য ধর্মের মানুষকে অস্বীকার করে, শত্রু বলে ধ্বংস করায় মেতে ওঠে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বকীয় ধর্মতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেদিক থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের ধর্ম ক্ষমতা দখলে নিঃস্ব হয়ে যায়। ক্ষমতা দখলের আয়োজনে ধর্মই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে ভারতের মানবধর্মের গৌরবান্বিত অস্তিত্বই যে মৌলবাদীদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠবে,তা আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতবিরোধিতাই যে মৌলবাদীদের পুঁজি, তা এবার দেশের সন্তানসন্ততির মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তোলার বা জনগণের মধ্যে যুদ্ধের জিগির জাগিয়ে অস্ত্রচালনার ট্রেনিং দেওয়ার প্ররোচনায় মধ্যেই প্রতীয়মান। সে দেশে সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের নৃশংস অত্যাচার নেমে আসার নেপথ্যেও মৌলবাদীদের ধর্মীয় বিদ্বেষের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় অত্যন্ত প্রকট। দেশভাগের রক্তক্ষরণ এখনও যে বন্ধ হয়নি!