এবং রবীন্দ্রনাথ

সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

লেখার দুনিয়ায় পাতি লেখকদের একটা দুর্নাম আছে৷ বিশেষ কারোর জন্মদিন বা মৃতু্যদিনে ঝাঁপিয়ে পডে় লিখতে শুরু করে দিই অঢেল অঢেল বাক্যবন্ধ৷ আর দিনটি যদি পঁচিশে বৈশাখ হয় অথবা বাইশে শ্রাবণ তাহলে তো কথাই নেই৷ কিন্ত্ত রবিঠাকুর কি এতই সহজে ধরা দেন পাতি লেখকের কলমের ডগায়? তাই কলমটি কে বেড় দিয়ে ধরে খুঁজতে শুরু করি শব্দের আল্পনা৷ দেখি হৃদয় জুডে় ছডি়য়ে আছেন প্রানের ঠাকুর৷ কলম আটকিয়ে যায়… অচল আঙুল ছন্দ তোলে না ল্যাপটপে… এগিয়ে যেতে যেতেই কান পেতে রই…
কবিগুরুর প্রথম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল কবে? রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী (বড়দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে) সরলা দেবী তাঁর আত্মকথা “জীবনের ঝরাপাতা “-তে লিখছেন..” রবি-মামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই৷ তখন মেজমামা(সত্যেন্দ্রনাথ) ও নতুনমামার(জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি(রবীন্দ্রনাথ) ৪৯নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন৷ অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুলফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল এবং একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রনাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম৷ তখন আর সবাই জেগে উঠলেন৷…সেই বছর থেকে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হোল৷” সেই বছরটি ছিল ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (১৮৮৭ সালের ৭ই মে// কবির বয়স তখন ২৫ পেরিয়ে ২৬শে পদার্পন)৷

ধর্মবোধের স্বচ্ছতায় পৌঁছতে কবিগুরুর একটি নিজস্ব যাত্রাপথ আছে৷ জীবনের ধাপগুলি ভাঙতে ভাঙতে তিনি পূজামন্দিরের বাইরে যাত্রা করেছেন৷ সাধারণত আমাদের দেশে মানুষ বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের সম্প্রদায় সীমার মধ্যে আরো নিবিষ্ট হয়, চারপাশের ঘেরাটোপ আরো ঘন হতে থাকে৷ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটি ঘটেছে৷ তিনি একটি একটি করে সম্প্রদায় বন্ধনের সংস্কার বেড়িগুলি মোচন করতে করতে পথ হেঁটেছেন৷ আমরা এই যাত্রাটিকে একটু দেখতে চাইব৷


জন্মসূত্রেই একটি মুক্তি জড়িয়ে ছিল তাঁকে, অন্য অর্থে আপাত বন্ধনও বলা যায়৷ সমাজ চিহ্নিত করেছিল যশোরের কুশারী বংশকে পীরালি ব্রাহ্মণ বলে৷ সাহস করে পীরালি ব্রাহ্মণের কন্যা বিবাহ করেছিলেন ঠাকুর বংশের পূর্বপুরুষ৷ সেই গল্প অনেকেরই জানা৷ সমাজের প্রত্যাখ্যান গায়ে জড়িয়েই বিস্তার ঘটল শাখাটির৷ যশোর থেকে কলকাতা—কুশারী থেকে ঠাকুর৷ সাধারণ অবস্থা থেকে ধনসমৃদ্ধি, পীরালি ছাপ তো ঘুচল না৷ এমনকি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পরেও নয়৷ বিবাহ ইত্যাদিতে যথেষ্ট অসুবিধা হত৷ এই ইতিহাস তো গোড়া থেকেই সংবেদনশীল মনে জাতপাতের সংকীর্ণতা নিয়ে বিরুদ্ধতা জাগাবে এটা অনুমান করা যায়৷ শুধু জাতপাত নয়, গোড়া থেকেই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের মনে একটা বিরূপতা লক্ষ্য করি৷

সকলেই জানেন বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন৷ সক্রিয় রাজনীতিতে পরিপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করে বক্তৃতা দিয়েছেন, গান বেঁধে গেয়েছেন, মিছিলে পা মিলিয়েছেন৷ কিন্ত্ত একটা সময় তিনি সরে গেলেন৷ কেন তাঁর এই সরে যাওয়া তা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আছে৷ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি আমাদের পথ দেখায় অবশ্যই৷ তাঁর অনুভবে ধরা পড়েছিল আন্দোলনের অন্তর্গত ছিদ্রগুলি৷ দেশের সমস্ত সম্প্রদায় মিলতে পারছে না, বরং আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে ভাঙনের জীবাণু৷ এক ঝোঁকা হয়ে পড়ছে ব্যাপারটা, বয়কট নিয়ে জবরদস্তি ছাড়াও নেতাদের অনেকেই বড়ো করে তুলছেন গীতা, শিবাজী উৎসব, ভবানীপূজা, আনন্দমঠ, শক্তিরূপিণী কালিকা ইত্যাদি হিন্দু ভাবাদর্শের নানা দিক যা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মনে জাগিয়ে তুলছে সংশয়, সন্দেহ, বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা৷ এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে অতিশয়পন্থা, ‘গুলি বন্দুক বোমার আগুনে’ অন্য বাঁক নিচ্ছে আন্দোলন৷ রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের আত্মত্যাগকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন কিন্ত্ত কদাপি তিনি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করেননি৷ জোরজুলুম, জবরদস্তিকে তিনি বরাবর ঘৃণা করেছেন৷ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ আর তার দলবলের জোর করে দোকান লুট, দোকানের বিদেশি কাপড় কেড়ে নিয়ে পোড়ানো মনে পড়তে পারে৷ মুসলমান সম্প্রদায় এবং নিম্নবর্গের হিন্দুদের সঙ্গেও এক সম্পর্ক-ফাটল তৈরি হয়েছিল ঐ সময়৷ পরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের ধারণা ভুল ছিল না একেবারেই৷ সেবারে আটকানো গেলেও ১৯৪৭-এ দেশভাগ আর আটকানো গেল না৷

হিন্দু মুসলমানের মিলন কোনো বাইরের স্লোগান দিয়ে ঘটানো যেতে পারে এ কথা তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি৷ চিরাগত সংস্কারের পরিবর্তন করা দুই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সহজ নয়৷ কিন্ত্ত দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়, আর তার জন্য কী প্রয়োজন তা তিনি বারবার বলেছেন৷ রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় কখনো হাত মিললেও ভেতরে রন্ধ্র রয়ে গেছে৷

এই আচার ও বাহ্যবিধান সর্বস্বতাকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন ধর্মতন্ত্র, মানবের নিত্যধর্মের সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই৷ ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই পালটাতে হবে—এ ছাড়া কোনো শর্টকাট নেই৷ এককালে দুই সম্প্রদায়ে একরকমের মিল ছিল৷ তার মূলে মধ্যযুগীয় সন্তদের অবদান কম ছিল না৷ পরস্পরের তফাত মেনেও আমরা কাছাকাছি ছিলাম৷ কিন্ত্ত সেই সহজ ধর্মবোধ থেকে বিচু্যত হয়ে রাজনৈতিক সমাজের অন্তর্গত হয়ে আমরা ধর্মের অভিমান আরো বাড়িয়ে তুলেছি৷ একেবারে টায়ে টায়ে তুলনা দিয়ে তিনি বলেছেন হিন্দুরা মসজিদের সামনে ঠাকুর নেবার সময় ঢাকে জোরে কাঠি দিয়েছে, মুসলমানরা র্কোবানির উৎসাহ পূর্বের চেয়ে বাড়িয়ে তুলেছে৷ পরস্পরের ধর্মের অভিমানকে আঘাত দেবার স্পর্ধাই দুদলের প্রেরণা৷ এই অভিশাপ থেকে উদ্ধার পাবার পথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্টভাষায় লিখে গেছেন৷ তবে সে পথ এক ভিন্ন যাপনপ্রণালী—সংস্কার মুক্তির দীক্ষা৷১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন তাই সমুদ্রহৃদয় যন্ত্রণামথিত করে তাঁকে দেখতে হয়নি কীভাবে রক্তপিচ্ছিল পথে ধ্বংস হত্যা ভ্রাতৃবিরোধের চুনকালি মেখে তাঁর খণ্ডিত দেশের মানুষ জগৎসভায় মাথা হেঁট করে দাঁড়ালো৷ মুণ্ড হেঁট হলেও হাতে কিন্ত্ত অস্ত্র আছে, অর্জুনবিষাদ যোগ ঘটেনি৷

আমাদের সমাজের বদ্ধমূল বর্ণাশ্রম ও জাতপাত নিয়ে বহুবার বহু লেখায় তিনি মতপ্রকাশ করেছেন৷ ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছো অপমান’ কবিতাটি যেন চিরকাল তাঁর মর্মে গেঁথে ছিল৷ কথা ও কাহিনীর কবিতাগুলির মধ্যেও তিনি সন্ধিৎসু আর্তিতে খুঁজে ফিরেছেন মিলনের পথ৷ ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা বিশেষভাবে সকলের মনে পড়বে৷ বিখ্যাত কন্নড কথাসাহিত্যিক ইউ, আর, অনন্তমূর্তি একবার শঙ্খ ঘোষকে বলেছিলেন ভারতের সর্বত্র ‘গোরা’ উপন্যাস নিয়ে আলোচনাচক্র করা উচিত৷ ভেদবুদ্ধির বিনাশ-ওষধি আছে ওই উপন্যাসে এই ধারণা ছিল তাঁর৷ চরঘোষপুরে গোরার অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত বহু আলোচিত৷ অন্যায়কারী ব্রাহ্মণের বাড়িতে জলপান করতে যাবার পথে বাঁক নিয়ে গোরা ফিরে এল সেই নাপিতের বাড়িতেই, যারা স্বামী স্ত্রী বিপন্ন মুসলমান বালক তমিজকে আশ্রয় দিয়েছে, পালন করছে সন্তানস্নেহে৷
এই প্রবন্ধে আমরা একটু দেখে নিতে চাই জাতিভেদের তত্ত্বটি তিনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেছেন৷ পাশ্চাত্যের শ্রোতার কাছে বলবার সময় তিনি জানিয়েছিলেন মানুষের মধ্যে যে জাতিগত বৈচিত্র্য আছে তা বহুজাতি অধু্যষিত ভারতবর্ষ অনুভব করেছিল৷ ভারতবর্ষ একধরনের অচল অটল জগদ্দল সীমানা-টানা সমাজ তৈরি করে নেতিবাচক শান্তি ও শৃঙ্খলা তৈরি করেছিল৷ এই সমাজের অর্থনৈতিক বনিয়াদ কীভাবে অক্ষত ছিল, কীভাবে গড়ে উঠেছে শিল্প-বাণিজ্য, কীভাবে নিশ্চিত হয়েছে জীবিকাসমূহ তার ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে দেখিয়েছেন কীভাবে এক একটি সওদাগরি বা একএকটি পেশাকে ভারতবর্ষে একএকটি বর্ণের উপর বা তার উপবিভাগ জাতের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে৷ এতে প্রতিযোগিতা কমে গেছে, ঈর্ষা বা ঘৃণা, আপাতদৃষ্টিতে কমেছে কিন্ত্ত গোটা প্রক্রিয়াটি যেহেতু বংশগত উত্তরাধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, ভারতবর্ষ এক অচলায়তনে পরিণত হয়েছে৷কিন্ত্ত পাশাপাশি পশ্চিমী ব্যবস্থার অসাম্য ও অশান্তির কথাও তিনি সমানভাবে তুলে ধরেছেন৷ ভারতবর্ষ সাম্যময় সাফল্যে পৌঁছতে পারেনি, কিন্ত্ত পাশ্চাত্যে ভেদাভেদ, অসাম্য কম ভয়ানক নয়৷সেখানে ভিন্নতাকে স্বীকার করাই হয় না৷