• facebook
  • twitter
Sunday, 20 April, 2025

সব দলের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে!

এসএসসিতে যোগ্যদের চাকরি ফেরানোর দাবি

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

এ এক অভূতপূর্ব ঐক্য। সরকারি ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে যেভাবে যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাঁচানোর ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। অনেকদিন ধরেই এক লটে প্রায় ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল নিয়ে গোটা রাজ্যেজুড়ে অনিশ্চয়তার চাপা আতঙ্ক জেগে ছিল। সেখানে ৩ এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে ২০১৬-র এসএসসি’র ২৫৭৫৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের পুরো প্যানেল বাতিল হওয়ার পর অনেকেরই মনে হয়েছিল রাজ্যে তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দেবে, সরকারবিরোধী আন্দোলন আছড়ে পড়বে, চাকরিহারাদের বেলাগাম প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করবে। বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগে তীব্র বিস্ফোণের অপেক্ষার মতো তীব্র কৌতূহলী মানুষের মনে ছিল তীব্র উৎকণ্ঠা। অথচ তার পরিচয়ের অভাব অনেকেই নিরাশ করেছে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পালে প্রবল হাওয়া লাগার আগেই বিপদ বুঝে সরকার ও শাসকদলের অতি সক্রিয় উদ্যোগ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাসের পাশাপাশি অযোগ্যদেরও আশ্বস্ত করার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বানভাসি মানুষের কাঠখড় ধরে বেঁচে থাকার মরীয়া চেষ্টার মতো যোগ্য চাকরিহারাদের নির্মম পরিণতিতে সেই ঘনঘোর প্রতিবাদী মেঘে বিদ্যুৎঝলক দেখা দিয়েও প্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টি এখনও দেখা দেয়নি। শরতে অকাল মেঘের মতোই তাতে বৃষ্টি না হলেও সপ্তাহ জুড়ে ঝড় বয়ে চলেছে। সেখানে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর জন্য প্রায় সব দলের মধ্যেই তীব্র সদিচ্ছা থেকে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সেখানে যোগ্যদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সেভাবে শোনা না গেলেও উল্টে চাকরি বাঁচানোর মরীয়া চেষ্টায় সরকারের পাশাপাশি বিরোধীদের কাছে আশ্রয়প্রার্থীর পরিচয় ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সুযোগে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সুযোগ্য প্রমাণের সক্রিয় প্রয়াস দেখা যাচ্ছে,তাও সচরাচর মেলে না। সরকার যদি আগে থেকেই যোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে তার আন্তরিকতায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করত বা হাইকোর্টের রায়কে মান্যতা দিত, তাহলে আজ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হত না,বা, শিক্ষাক্ষেত্রের অচলাবস্থার জল এতদূর গড়াত না।

অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহযোগিতার মধ্যেও পালে হাওয়া পাওয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ লক্ষণীয়। এতদিন শুধু যোগ্যদের পাশে থাকার আশ্বাস বা সরকারে এলে যোগ্যদের চাকরির প্রতিশ্রুতিই ছিল বিরোধী দলগুলির মূলধন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অতিদ্রুত যোগ্যদের পাশে থাকার তৎপরতার মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার সদিচ্ছায় সেই মূলধন সুদেআসলে অনেক গুণ শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। সেখানে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংগঠিত দুর্নীতিতে এ রকম বিপুল সংখ্যক চাকরি বাতিলে যোগ্যদের জীবনের দুর্যোগই সরকারবিরোধী দলগুলোর কাছে সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। হাতে গরম টাটকা প্রমাণের নজির যাতে কোনওভাবেই ঠান্ডা হয়ে না যায়,তার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আন্তরিক আয়োজনে বিরোধী দলগুলির সক্রিয় ভূমিকা আপনাতেই প্রকাশমুখর। সেক্ষেত্রে যোগ্যদের তালিকা তুলে দিয়ে তাঁদের চাকরি বাঁচানোর দাবিতে সরকারবিরোধী জোরালো বক্তব্যে বারবার সরকারের দুর্নীতিকে তুলোধোনা করে তার ক্ষমতায় থাকার অধিকারহীনতা থেকে অযোগ্যতার কথা উঠে আসে। সেদিক থেকে চাকরি হারানো নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনমানসে যে তীব্র অসন্তোষ জেগে উঠেছে,তা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছে না। সেক্ষেত্রে যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর যজ্ঞে সকলের মধ্যে ঘি ঢালার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অথচ তার অনিশ্চিত পরিণতি নিয়ে এখনও কোন্ও আলোর রেখা না দেখা দেওয়ায় সেই যজ্ঞের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

আসলে যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর সাধু উদ্যোগের মধ্যেই বহুমুখী উদ্দেশ্যমূলক প্ররোচনাও বর্তমান। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিপুল সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি বাতিল হওয়ার পরেই জনমানসে বিপুল বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সুযোগ নেওয়া থেকে দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার সযত্ন প্রয়াস অত্যন্ত স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বিপদ বুঝে সরকারের যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা থেকে পরবর্তীতে অযোগ্যদেরও দেখার আশ্বাসে ভারসাম্য বজায় রাখার মরীয়া প্রয়াসে তার আসল লক্ষ্যও গোপন থাকেনি। সেক্ষেত্রে যে অযোগ্যদের চাকরির মাশুলে যোগ্যদেরও চাকরি হারাতে হয়েছে,সেই অযোগ্যদের দেখার বার্তাতেই সরকারের মনোভাব বুঝে নিতে কষ্ট কল্পনার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে বিরোধীদের যোগ্যদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শনও নির্ভেজাল নয়। তার মধ্যেও সরকারের দুর্নীতিকে আরও বেশি সামনে তুলে ধরার সদিচ্ছা বর্তমান। সেখানে যোগ্যদের এখনও আলাদা করা সম্ভব বা বাছাই করা যাবে’র ধারণাকে হাতিয়ার করে সরকারের সামনে সমস্যা সমাধানের নতুন প্রস্তাব রাখার সচেতন প্রয়াসের মধ্যেও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংগঠিত দুর্নীতিকে নগ্ন করে তুলে ধরে সরকারের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দেওয়ার ছকটি বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

শুধু তাই নয়, তা সরকারের কাছে শাঁখের করাতের মতো, প্রস্তাবটি মেনে নিলেও বিপদ, আবার অমান্য করলেও সংকট। সরকারের সদিচ্ছার অভাবই তখন বিরোধীদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে সরকারের যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর দায়বদ্ধতা যতই উচ্চস্বরে ধ্বনিত হোক তাতে বিশ্বাসের আলো পথ দেখাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, সেখানে সরকারের যোগ্য শিক্ষকদের ভলিয়েন্টারি সার্ভিস দেওয়ার বিকল্প প্রস্তাবও তীব্র সমালোচিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে আবার মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে রায়ের পুনর্বিবেচনার উপরে ভরসা করার আশ্বাসেও যোগ্যদের চাকরি ফিরে পাওয়ার বিশ্বাস ফিরে না পাওয়ায় তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বেতন বন্ধ না করার দাবি নিয়ে ৯ এপ্রিল ডিআই অফিসে গিয়ে যোগ্য নিরীহ শিক্ষকদের উপরে পুলিশের নির্মম দমনপীড়নের ছবি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, রাজ্য জুড়ে তার তীব্র প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে যোগ্যদের তালিকা দিয়ে যোগ্য শিক্ষকের চাকরি বাঁচানোর দাবিতে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যই সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে। এতে যে সরকারের ভাবমূর্তি ক্রমশ কালিমালিপ্ত হচ্ছে এবং ছাব্বিশে নির্বাচনের পক্ষে অশনি সংকেত হয়ে উঠছে, তা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে সরকার ও সরকারবিরোধী দলগুলোর যোগ্যদের পাশে থাকার তীব্র প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যাশা জাগালেও তাতে সদুত্তর মেলানো দুরূহ।

আসলে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর যজ্ঞ দেখে মনে হয়, সকলের সাধু উদ্যোগেই তা ফলপ্রসূ হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু বিষয়টি তত সহজ নয়। যেখানে যোগ্যদের বাঁচানোতে সুযোগ্য প্রমাণের হাতছানি থাকে, সেখানে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। তার চেয়েও জোরালো হয়ে ওঠে অযোগ্য বা ব্যর্থতা প্রমাণের দুর্লভ সুযোগ যাতে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দুর্লভ হাতছানি মেলে। অন্যদিকে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর মাধ্যমে সরকারে ক্ষমতা ধরে রাখার শাসক দলের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোয় কেউ ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখে, কেই ক্ষমতা ধরে রাখার রক্ষাকবচ খুঁজে নেয়। সেখানে যোগ্য-অযোগ্যের পার্থক্যের চেয়েও সরকার ও বিরোধীর মতপার্থক্য আরও প্রকট,আরও ব্যাপক। তার মাঝে যোগ্যদের অস্তিত্ব সংকট আরও বিপন্ন। কেননা তাঁদের চাকরি রক্ষাই এখন সরকারি ও বিরোধী দলের যজ্ঞের কাঠ বা খেলার বাজি। তাতে সকলের দৃষ্টিনিবদ্ধ হলেও লক্ষ্য থাকে নিজেদের স্বার্থপূরণে। যজ্ঞ করা বা খেলার প্রয়াসও সেখানে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সকলের মধ্যেই যথাসাধ্য চেষ্টা করার প্রবণতাই সেখানে পাশে থাকার অত্যন্ত জরুরি প্রমাণে যোগ্যদের পাশে থাকার ছাড়পত্র হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে দিকে যোগ্য-অযোগ্যদের পার্থক্যের বিষয়টি এমনিতে প্রমাণের অভাবে অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন,তার উপরে যোগ্যদের অযোগ্যবিরোধী প্রতিবাদও সেভাবে জোরালো ভাবে জনসমর্থন লাভ করেনি। অসংখ্য যোগ্য প্রার্থী বছরের পর আন্দোলন-অনশন, ধর্ণা,মিটিং মিছিল করেও যোগ্যতা প্রমাণের বাইরে থেকে গেছে। তার উপরে সকলের চাকরি টিকে গেলে যোগ্যরাও আর অযোগ্যদের বিরুদ্ধে সরকারের দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় হত না। সেখানে যোগ্যদের প্রতিবাদী আন্দোলনে নিজেদের নিরঙ্কুশ যোগ্যতাও সেভাবে জনমানসে তীব্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির আধারেই যোগ্যদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি আবর্তিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য তা নিয়ে যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর যজ্ঞ কতটা কার্যকরী হবে,তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা সেখানে যোগ্যদের পৃথকীকরণে অযোগ্যদের নিয়ে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ হাতে দিয়ে সরকার তার অন্তর্জলী যাত্রাকে সুনিশ্চিত করবে না। অন্যদিকে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া যোগ্যদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধীদের দাবি আন্দোলন জোরালো হলেও তা ফলপ্রসূ হতে পারে না। সেখানেও সরকারে এসে তা করার প্রতিশ্রুতিই একমাত্র সম্বল হাতে থাকে। সবদিক থেকেই যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর যজ্ঞ যতই সরগরম হয়ে উঠুক না কেন,তার ফলাফলে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হলেও তা ভস্মে ঘি ঢালার ব্যর্থতাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক করে তোলে।