অননুমোদিত অভিবাসন নিয়ে আমেরিকার খাঁড়ার ঘা

ঐতিহাসিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিথিল অভিবাসন নীতির মধ্য দিয়ে গেছে, তারপরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কঠোর অভিবাসন নীতির সময়কাল অতিক্রম করেছে। অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নীতিগত ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে নাগরিকত্ব নীতি এবং অপসারণ নীতি। ২০০৩ সাল থেকে, ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নের জন্য দায়ী এবং এই বিভাগের তিনটি সংস্থা রয়েছে যারা অভিবাসন তত্ত্বাবধান করে। ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট জাতীয় সীমান্তের চারপাশে আইন প্রয়োগ এবং অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের জন্য দায়ী। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত আর তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারত বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসীর উৎস।

ভারতীয়দের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের সংখ্যা ২০২০ সালের হিসাবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ ছিল। ২০২০ সালের জাতিসংঘ জনসংখ্যা বিভাগের হিসাব অনুসারে, ভারতীয় অভিবাসীদের জন্য শীর্ষ বৈশ্বিক গন্তব্য ছিল প্রথম আমেরিকা। বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করও সঠিক তথ্য দিয়ে বলতে পারবেন না, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অননুমোদিত ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা কত। তিনি এখনও অবধি জানাননি ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মার্কিন অভিবাসন নীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কারণে ভারতীয় নাগরিকদের সম্ভাব্য বহিষ্কার মোকাবিলা করার কোন পরিকল্পনা আছে কিনা, যদি থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য আছে কিনা। কিংবা সরকার বিদেশে ভারতীয়দের, যাদের মধ্যে অননুমোদিত অভিবাসীরাও রয়েছেন, যারা বহিষ্কার বা আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তাদের কোন আইনি সহায়তা বা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে কিনা, যদি থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য আছে কিনা এবং সরকার কি এই ধরনের অভিবাসীদের কাজের ভিসা এবং আইনি মর্যাদা প্রদানের জন্য মামলা গ্রহণের প্রস্তাব করছে।

এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ১০৪ জন ভারতীয় নির্বাসিতকে মার্কিন বিমানে আনা হয়েছিল, তবে তথ্য অনুসারে, এটিই প্রথমবার নয় যে ভারতীয়দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জয়শঙ্কর একটি বিবৃতি দেন। রাজ্যসভায় বিরোধী দলের সদস্যদের উত্থাপিত প্রশ্নেরও তিনি জবাব দেন। দাবি করেন যে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো কোনও নতুন ঘটনা নয়। জয়শঙ্কর বলেন, ২০০৯ সাল থেকে মোট ১৫,৭৫৬ জন অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মার্কিন মাটিতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করা ১০৪ জন ভারতীয়কে সামরিক বিমানে করে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোটা কিন্তু শোভনীয় নয়। তারা সবাই অপরাধী নাও হতে পারে। অসহায়তাও কারণ হতে পারে। কিংবা অন্য কোন বাধ্যবাধকতায় তারা নিয়মের ফাঁকে পডে গিয়ে থাকতে পারেন। বিদেশমন্ত্রীর বক্তব্যে কোন প্রতিফলন নেই। অনেকে বলছেন, অননুমোদিত অভিবাসনের বিষয়ে মোদী বা ট্রাম্প সরকার এখন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বিদেশমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন কি বাকীদের সংখ্যা কত বা তাদের মানবিক ভাবে দেশে ফেরাতে বা এদেশে পুনর্বাসিত করতে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? না। বরং আমেরিকার চাটুকারিতা করে যাচ্ছেন।আসলে তাদের সরকার অসম বা অন্যত্র NRC-র নাম দিয়ে মানুষকে ভীত সন্ত্রস্থ করে রাখছে ঠিক যেমন আমেরিকা করছে অননুমোদিত অভিবাসীদের নিয়ে। অথচ, ২০০৯ সাল থেকে ১৫,০০০ এরও বেশি ভারতীয় অভিবাসীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে এটা একটা রূঢ় সত্য।


২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, ২৯ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় অভিবাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় জনসংখ্যা ক্রমাগত এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ভারতীয় আমেরিকাতে এসেছে। ভারতীয় অভিবাসীরা অত্যন্ত দক্ষ এবং উল্লেখযোগ্য আয় অর্জন করেন। বিশাল সংখ্যক ভারতীয়দের স্নাতক ডিগ্রি বা তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা। তাদের গড় আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সামগ্রিকভাবে বিদেশে জন্মগ্রহণকারী জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি এবং দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসের সম্ভাবনা এই গোষ্ঠীগুলির অর্ধেক। ভারতীয়রা মার্কিন উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বৃহত্তম দল এবং ২০২৩ অর্থবছরে (FY) জারি করা অত্যন্ত দক্ষ কর্মীদের জন্য H-1B অস্থায়ী ভিসার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পেয়েছে। এ

ই ভারতীয় মানবসম্পদের কি কোন বিশেষ মূল্য নেই বেনিয়া ট্রাম্প সরকারের কাছে? ভারত কেন এই অমানবিকতা মেনে নিচ্ছে? ১৯৬৫ সালের অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের প্রেক্ষিতে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। নিয়মতান্ত্রিক জটিলতায় অননুমোদিত অভিবাসনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া অনুমোদন না নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যাও খুব স্পষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্য হল, মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (CBP) ২০২৩ অর্থবছরে সীমান্ত বা বিমানবন্দরে অনিয়মিতভাবে আসা ভারতীয় অভিবাসীদের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, প্রায় ৯৭,০০০, কিন্তু পরের বছর তা কিছুটা কমে প্রায় ৯০,০০০-এ দাঁড়িয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বেশিরভাগ অভিবাসীর মুখোমুখি মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে হলেও, ২০২৪ অর্থবছরে মার্কিন-কানাডা সীমান্তে প্রায় ৪৪,০০০ ভারতীয় নাগরিকের মুখোমুখি হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয়দের সংখ্যা ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবার হিসাবে অনিয়মিতভাবে এসেছে, তবে তাদের বেশিরভাগই একক প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে এসেছে। এই অভিবাসীদের অনেকেই উত্তর ভারতের কিছু অংশ থেকে এসেছেন যেখানে তরুণরা – বিশেষ করে শিক্ষিতরা, উচ্চ হারে বেকারত্ব এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

যতদূর জানা গিয়েছে ভারত সরকারের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অননুমোদিত ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যার কোনও তথ্য নেই। কারণ হল এই অভিবাসীরা বৈধভাবে ভারত ত্যাগ করেছেন কিন্তু হয় তাদের মার্কিন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, অথবা অবৈধভাবে বা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন। যদিও নির্বাসনের সমস্ত ক্ষেত্রে ভারত সরকার মার্কিন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় করে কাজ করে চলে, মার্কিন পক্ষ থেকে নির্বাসনের জন্য চিহ্নিত ব্যক্তিদের তালিকা ভারত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা নিবিড়ভাবে যাচাই এবং যাচাই করা একটা নিয়মমাফিক কাজ। শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিদেরই মার্কিন সরকার ভারতে নির্বাসনের জন্য গ্রহণ করে যাদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে যাচাই করা হয়। তাই বিদেশে ভারতীয়দের নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে সাহায্য এবং সহায়তা প্রদান করা হয়। সরকার বৈধ অভিবাসন এবং গতিশীলতা সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে পুরো ওয়াকিবহাল থাকবে এটা তো আশা করাই যায়। আমেরিকাতে ট্রাম্প এল আর বিদেশে বেআইনী বা অন্যায়ভাবে বসবাসকারী ভারতীয়দের এই প্রথম শেকলে বেঁধে উড়োজাহাজে করে দিল্লি পাঠিয়ে বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরের সঙ্গে মজা করছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। কারণ ২০২৫ সালের চেয়ে বেশি অভিবাসীকে ভারতে ফেরত পাঠিয়েছিল বাইডেন ও ওবামা প্রশাসন। বলতে পারেন ট্রাম্প বেশি প্রচার দিয়ে হাইপ নিয়েছেন।

অনুমোদন ছাড়াই ভ্রমণকারী অভিবাসীরা প্রায়শই ভ্রমণ সুবিধা প্রদানকারীদের হাজার হাজার ডলার প্রদান করে যারা তাদের দীর্ঘ শৃঙ্খলিত দেশগুলির মধ্য দিয়ে পাঠায় যেখানে ভিসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে – একটি প্রক্রিয়া যা “গাধার বিমান” নামে পরিচিত – অবশেষে মার্কিন সীমান্তে পৌঁছানোর আগে। কিছুদিন আগে শাহরুখ খান অভিনীত ‘ডাঙ্কি’ ছবি ভীষণ বাস্তবোচিতভাবে এই প্রক্রিয়ার নানা দিক তুলে ধরেছে।

১৮৮০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ২.৩ কোটিরও বেশি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। যদিও তাদের বেশিরভাগ শহরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন, তবে সবাই স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেননি। কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা ছিল।বর্তমানে পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলারে আমেরিকাতে থাকার অনুমোদন দেওয়ার কথা বলছে ট্রাম্পের আমেরিকা। অনেকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া রয়ে যায় শরণার্থী বিষয়টা যদিও ভারত আমেরিকা প্রতিবেশী দেশ নয়। অন্যদিকে, ভারতে অননুমোদিত অভিবাসনকারীদের অমানবিকভাবে না তাড়িয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা আজও চলছে। মার্কিন গৃহযুদ্ধের পরপরই কিছু অঙ্গরাজ্য নিজস্ব অভিবাসন আইন প্রণয়ন করতে শুরু করে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত ১৮৭৫ সালে রায় দেয় যে অভিবাসন নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের।১৮৭৫ সালেই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম অভিবাসন আইন পাস করে, যা পেজ অ্যাক্ট ১৮৭৫ নামে পরিচিত। বিষ্ময়ের কথা হল, এটি মূলত এশীয় অভিবাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য তৈরি করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে এশীয় চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, তাদের নিজ নিজ দেশে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

মনে পড়ছে কোভিডের ভয়ংকর দিনগুলিতে এই ট্রাম্প সরকার WHO কে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন কি Hydroxychloroquine-এর জন্য ভারত আক্রমণের হুমকি দিতে ছাড়েনি। ভারতে বহিরাগতরা কম আসেনি। কিন্তু ভারততীর্থে যে রবীন্দ্রনাথ গাইতে পারেন যথার্থভাবে শিখ হূনদল মোঘল পাঠান একদেহে লীন হওয়ার কথা “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে”। আমেরিকা Mellting Pot বা Melting Cauldron-এর কথা বললেও সামরিক বিমানে শেকল পরিয়ে মানুষকে জানোয়ারের মত দেশ থেকে বার করে দেয়। আজ এত অসম্মান করে ভারতীয়দের আইনের দোহাই পেড়ে আমরিকা অমানবিকভাবে ভারতীয়দের বার করে দিয়ে মুড়ি মিছরি এক করে দিচ্ছে কি অজ্ঞাত কারণে মোদী সরকার চুপ করে আছে –তা কি প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে এক মঞ্চে ভাষণ দিয়ে ভারতের বিদেশনীতির সফলতার ঢাক পেটাবে বলে?