নেতাজির অন্তিম পরিণতি রহস্যাবৃত রাখার চেষ্টা চললেও সত্য ক্রমশ প্রতীয়মান

ফাইল চিত্র

শান্তনু রায়

চলে গেল ২১শে অক্টোবর। এ দিনটা এলেই আপামর দেশবাসী যেমন একদিকে উজ্জীবিত ও প্রাণিত হয় তাঁদের প্রিয় নেতার দূরদর্শিতা নির্ভীকতা স্বচ্ছ রাষ্ট্রচিন্তন এবং দেশের প্রতি ভালবাসার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্মরণ করে তেমনই তাঁদের মন এক বিষন্নতায় ছুঁয়ে যায় এই ভেবে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পূর্বএশিয়ার সমরাঙ্গন থেকে যে যোদ্ধা সন্ন্যাসীর দেশবাসীর প্রতি সেই বলিষ্ঠ আহ্বান-In the name of God, in the name of by-gone generations who have welded Indian People into one nation and in the name of Dead Heroes who have bequeathed to us a tradition of heroism and self sacrifice-we call upon the Indian People to rally round our banner and to strike for India’s freedom” আজও যেন ইম্ফল মইরাং এর প্রান্তরে প্রান্তরে বাতাসে অনুরণিত হয়ে কবির ভাষায় ডাক দিয়ে যায় –‘বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি/ রক্তে তোমার দুলছে নাকি প্রাণ’- সেই ইতিহাস পুরুষের শেষ পরিণতি আজও রহস্যাবৃত করে রাখা ইচ্ছাকৃ্তভাবে – কখনও সরকারি অপচেষ্টায় ও কখনও ঔদাসীন্যের শীতলতায় । প্রশ্ন জাগে ফৈজাবাদের গুমনামি বাবাই কি নেতাজি নন-পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ তো সেকথাই বলে ,তবে সরকারি স্বীকৃ্তে অনীহা ও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কেন? স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের চাপ এতই প্রবল!

অনেকেই সঙ্গত কারণেই মনে করছেন সম্প্রতি গুমনামি বাবার ডিএন এ পরীক্ষার রিপোর্ট সংক্রান্ত এক আর টি আই প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরী প্রদত্ত উক্ত উত্তর কেবল সরকারের এ ব্যাপারে সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় না এর নিগূঢ়ার্থ প্রমাণ করে এক দ্বিচারিতা ও অনৈতিকতাও৷
২০১৯এর সেরা বাংলা ছবি হিসেবে ৬৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া গুমনামি ছবিটি সেন্সর বোর্ডের অনুমোদনলাভের পরও মুক্তির কয়েকমাস আগে থেকেই এক বিতর্ক-বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছিল,এমনকি রাজনৈতিক মহলের একাংশের বিরুপতাও। বসুবাড়ির দু-একজন সদস্য সহ একটা মহল ছবিটির মুক্তি রুখতে যথাসাধ্য চেষ্ঠা করেছিলেন। একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মুখার্জি কমিশনের সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষন এ অখুশি এক শক্তিশালী গোষ্ঠী যারা এ যাবৎ বিমান দূর্ঘটনার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়নি হাজার অপচেষ্টা সত্ত্বেও তাদেরই এক সংঘবদ্ধ কৌশলী প্রয়াস ছিল সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধ করা।


পরবর্তীকালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সন্ন্যাসী দেশনায়ক’ চলচ্চিত্রটিও ‘গুমনামি’ ছবিটির মতই সাধারন দেশবাসী ও নেতাজি অনুরাগীদের মনে তাদের প্রিয়তম নেতার অন্তিম পরিনতি সম্বন্ধে সম্ভাব্য সত্য ধারণাই সুদৃঢ় করেছে,স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের এযাবৎ প্রচারিত ‘বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যু’র কল্পকাহিনীর ও এব্যাপারে সরকারি নীতির অসারতা অনুধাবনে৷ অনেকেরই স্মরণ থাকতে পারে।

প্রসঙ্গত সুভাষচন্দ্রের দার্শনিক মননশীলতা ও মনীষার গভীরতা অনুধাবনের অনীহায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর মত ও পথ এবং তাঁর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের অতুলনীয় ভূমিকার গুরুত্ব অস্বীকার বা অবমূল্যায়নের পল্লবগ্রাহী বঙ্গীয় হালফিলের বৌদ্ধিক প্রবণতা যেমন দূর্ভাগ্যের ও বেদনার তেমনই দুঃখের ও হতাশার যে সেই ইতিহাস পুরুষের অন্তিম পরিণতি সম্বন্ধে সত্য গোপন করার দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা (অপ)কৌশলে আজও ক্ষান্তি নেই – কেন্দ্রে শাসকের পরিবর্তন হলেও এ ব্যাপারে মনোভাব বিশেষ পরিবর্তন হয়নি; সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে৷
আজাদ হিন্দ সরকারের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী সমারোহে উদযাপনে ও এ উপলক্ষে কিছু সদর্থক ঘোষণায় আনন্দিত দেশবাসী্র‌, যাদের হৃদয়ে চিরযোদ্ধা-সন্ন্যাসীর স্থান চিরস্থায়ী, মধ্যে এক আশা জেগেছিল এবার সরকার হয়তো এই ইতিহাস পুরুষের রহস্যজনক অন্তর্ধান ও শেষ পরিনতি সম্পর্কে সত্য দেশেরমানুষকে জানাতেও সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে৷ কিন্তু দূর্ভাগ্য ও হতাশার এই যে ব্যাপারটা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে; হতাশ দেশবাসীর ক্রমশ অনুভুত হচ্ছে পূর্বতন সরকারের কণ্ঠস্বর ও আচরণই যেন ধ্বনিত ও প্রতিফলিত বর্তমান সরকারের উবাচ ও দেহভাষায়৷ ইদানীংএ মনে করার কারণ ঘটছে যে নেতাজির প্রতি মনোভাবে ও আচরণে দিল্লীর তখতে বসা সর্বভারতীয় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিশেষ কোন পার্থক্য হয়ত নেই, প্রয়োজনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁর নাম ব্যবহার ব্যতীত৷ যদিও ইণ্ডিয়া গেটের সামনে নেতাজির মূর্তির আবরণ উন্মোচন ও আলোকয়ানের ব্যবস্থা্র মাধ্যমে স্বীকৃতিদানে পুনরায় একবার হয়ত ক্ষীণ আশা জেগেছিল এই সন্ন্যাসী দেশনায়কের শেষ পরিণতি সম্বন্ধীয় এ যাবৎ ইচ্ছাকৃতও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাখা রহস্য উন্মোচনের সম্ভাবনায়।

উল্লেখ্য, শাহনওয়াজ কমিটি ও খোসলা কমিশনের রিপোর্টের পর্যবেক্ষন খণ্ডনকরে ইতিমধ্যেই অধুনা প্রয়াত সাংবাদিক বরুব সেনগুপ্ত থেকে আরম্ভ করে ইদানীং লেখক সাংবাদিক অনুজ ধর ও অন্যা্ন্য নেতাজি গবেষকরাও তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে বিমানদূর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু এক সাজান ঘটনামাত্র৷ গুমনামিবাবাই যে নেতাজি এই ইঙ্গিত দিয়েছেন অনেক গ্রন্থকার পরবর্তীতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে৷

এই প্রেক্ষিতে তথ্য জানার অধিকার আইন অনুসারে বছর খানেক আগে বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক সায়ক সেনের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সংস্থার বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরীর কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন –মুখার্জি কমিশনের তত্ত্বাবাধানে গুমনামি বাবার যে ডিএন এ টেস্ট করা হয় তার ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট কোলকাতার সি এফ এস এল-এ রয়েছে কিনা৷না থাকলে রিপোটর্টি নষ্ট করার সরকারি আদেশের অনুলিপি ৷ রিপোর্টটি থাকলে যেহেতু মুখার্জি কমিশনে তা দেওয়া হয়নি এবং যেহেতু মুখার্জি কমিশনেরও অবলুপ্তি ঘটেছ তাই তৃতীয় পক্ষের হাতে সেগুলি যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তা দরখাস্তকারীকেই দেওয়া হোক৷এর উত্তরে সি এফ এস এল-এ পক্ষ থেকে দরখাস্তকারীকে জানানো হয়-জনৈক গুমনামি বাবার দাঁতের ডি এন এ টেস্টের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট এই ল্যাবরেটরিতেই আছে,কিন্তু আর টি আই অ্যাক্ট ২০০৫ এর ৮(১)(এ) ও (ই)ছাড়াও ১১(১) ধারায় নির্দিষ্ট এই রিপোর্টের কপি হস্তা্ন্তর করা যাবে না৷ প্রসঙ্গত ইলেক্ট্রোফোরেসিসের মাধ্যমে প্রস্তুত ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্টের ভিত্তিতেই ডি এন এ টেস্টের ফলাফল নির্নিত হয়৷মুখার্জি কমিশনের কাছে দাখিলি গুমনামি বাবা্র ডি এন এ রিপোর্টও এভাবেই প্রস্তুত হওয়া্র কথা যদিওলক্ষ্যনীয় এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট বা তার কোন অনুলিপি ডি এন এ রিপোর্টের সঙ্গে সন্নিবেশিত না হওয়ায় তা কমিশনের নজরে আসার বা এর বা তার ভিত্তিতে দ্বিতীয় কোন অভিমত গ্রহণও সম্ভব ছিল না৷এখন সি এফ এস এল এর র্এই জনমানসে চাঞ্চল্য সৃষ্টি্কারী উত্তরের ফলেই বিতর্ক দানা বাঁধার পাশাপাশি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক৷ কারণ তথ্য জানার আইনের ৮(১)(এ) অনুযায়ী- Notwithstandig anything contained in this Act,there shall be no obligation to give any citizen –
Information,disclosure of which would prejudicially affect the sovereignity and integrity of India the security,strategic,scientific or economic interest of the state,relation with foreign state or lead to incitement of an offence.

অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে জনৈক গুমনামী বাবার দাঁতের ডিএন এ টেস্টে্র ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে দেশের সার্বভৌমত্ব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তার প্রভাব পড়বে এবং হিংসা ছড়িয়ে পড়তে পারে যা অতীব বিস্ময়কর৷ কিন্তু এখানেই প্রশ্ন কেন ও কিভাবে? কারণ এতদিন ধরে তো নেতাজির বিশেষ ঘনিষ্ট ও তাঁর বিশিষ্ট অনুগামীদেরও দাবি এককথায় উড়িয়ে দিয়ে সরকার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন কোন মহল থেকে বলা হত যে গুমনামি বাবা ভগবানজী একজন সাধারন সাধু মাত্র, আদৌ নেতাজি নন; কেউ বা আরো একটু এগিয়ে বলতেন-প্ল্যান্টেড-ভণ্ড প্রতারক৷ তাহলে কিসের ভিত্তিতে এখন বোধ হচ্ছে যে এই সাধারন সাধুর ডি এন এ টেস্টে্র ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তার প্রভাব পড়বে কিংবা দেশের সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হতে পারে?এমন শংকার কারণ কি তা অবশ্যই ব্যাখ্যা্র দাবি রাখে৷দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সি এফ এস এল-এর বক্তব্য অনুসারে যদি কমিশনের কাছে দাখিলি গুমনামি বাবা্র ডি এন এ রিপোর্টও এই ইলেক্ট্রোফেরোগ্রামএর ভিত্তিতেই প্রস্তুত হয়ে থাকে এবং দু’টি্র মধ্যে কোন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষনগত অসামঞ্জস্য প্রতিফলিত না হয়ে থাকে তবে এই ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম প্রকাশ্যে এলে কেন অন্যরূপ প্রতিক্রিয়ার ‘আশংকা’ হচ্ছে সে ব্যাখ্যাও যে জরুরী৷

উল্লেখ্য, ঐ গবেষক সায়ক সেনের দাবি যে অতীতে এ বিষয়টি নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ে্র সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি নাকি ঐ ডি এন এ রিপোর্টের যথার্থতায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন৷ আরেক নেতাজি গবেষক ও সাংবাদিক অনুজ ধরের মতেও শুধু ডি এন এ পরীক্ষার রিপোর্ট নয়,হাতের লেখা পরীক্ষার রিপোর্টেও তথ্যবিকৃতি বা কারচুপি ঘটানোর সন্দেহ ছিল বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের।

প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির তৎকালীন ডিরেক্টর ড. ভি কে কাশ্যপের ২৮/০১/০৫ তারিখের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ডি এন এ পরীক্ষার ওই রিপোর্টটি সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম ছাড়াই নিদর্শ-২২২এ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এও উল্লেখ্যযে ইতিমধ্যে ২০০৪এ কংগ্রেসদল নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে৷
প্রসঙ্গত মুখার্জী তদন্ত কমিশনের ২০০৫ এ দাখিলি রিপোর্ট অনুসারে তথাকথিত বিমান দূর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি এবং জাপানে রেঙ্কোজী মন্দিরে রাখা চিতাভস্মও নেতাজির নয়৷উল্লেখ্য কমিশনের সামনে বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যুর গল্প প্রমান করতে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত সাতজনের অন্যতম মাননীয় প্রণবমুখোপাধ্যায় ১৯৯৫সালের অক্টোবরে গান্ধী পরিবারের মুখ রক্ষার্থে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হিসেবে শ্রীমতী অনীতা পাফের আগুসবারগের বাড়ীতে গিয়ে এমিলিয়ে শেঙ্কল এবং অনিতাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নেতাজির তথাকথিত চিতাভস্ম ভারতে নিয়ে আসায় তাঁদের সম্মতি আদায় করতে এবং এমিলিয়ের সম্মতিপত্র হিসেবে তাঁকে দিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে কিন্তু সফল হননি৷ এমিলিয়ে এ কাজে অস্বীকৃত হন এবং সাক্ষাতে প্রনববাবুকে জানিয়েও দেন যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না এবং রেঙ্কোজি মন্দিরে রক্ষিত চিতাভস্মের সঙ্গে নেতাজির কোন সম্পর্ক নেই।

মুখার্জি কমিশনে ‘বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যু’ প্রমাণ করতে অত্যুসাহী ঐ সাতজন সাক্ষীর কারোরই ‘ঘটনা’র প্রত্যক্ষ জ্ঞান না থাকায় তাঁদের কারো সাক্ষ্যই নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি কমিশনের। কিন্তু দূর্ভাগ্যের,কমিশনের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০০৪ এ কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরে আসায় কমিশনকে স্বাভা্বিক ভাবেই নতুন সরকারের সর্বাত্মক অসহযোগিতা,হয়ত চাপেরও সম্মুখীন হতে হয়েছিল৷ ইতিহাসের আরও সমাপতন এই যে ঐ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কোন সদর্থক পদক্ষেপ না নিয়ে, সেই প্রনব মুখোপাধ্যায় সহ মন্ত্রিগোষ্ঠীর পরামর্শেই রিপোর্টটি বামদলগুলি সমর্থিত প্রথম ইউপিএ সরকার উপযুক্ত কারন না দেখিয়ে এবং অধ্যক্ষের সহযোগিতায় এমন গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে সংসদে পর্যাপ্ত আলোচনার সুযোগ না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে খারিজ করে দেন। উল্লেখ্য মুখার্জি কমিশনের অন্যতম বিচার্য বিষয় ছিল ১৯৮৫ সালে ফৈজাবাদের রামভবনে গুমনামি বাবা ছদ্মনামে বাস করতে থাকা মৃত সাধু যাঁর মৃত্যু্র পর রামভবনের ডেরা থেকে পুলিশের উদ্ধার করা কয়েকট্রাঙ্ক ভর্তি বিশেষ কিছু বইপত্র ও অন্যান্য জিনিষ মিলিয়ে প্রায় ৩০০০ সামগ্রীর মধ্যে ছিল বসুপরিবারের পুরোনো ফটো এবং নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্রী ললিতাবসুর শনাক্ত মতে অনেকগুলি নেতাজির ব্যক্তিগত সামগ্রী, তিনিই নেতাজি অনুগামী ও ঘনিষ্ঠদের দাবিকৃ্ত নেতাজি কিনা।

প্রাপ্ত সামগ্রীর বিশেষত্বের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই বহুবার বিশ্লেষণে প্রমানিত গুমনামি বাবা সাধারন সাধু তো ছিলেনই না বরং পারিপার্শ্বিক এই সাক্ষ্যপ্রমানে প্রতিপন্ন যে তিনিই নেতাজি-কেবলমাত্র এক বাঙালি সাধু নন।
কমিশনের সামনে শুনানীকালে অবশ্য এসব বিষয় উপস্থাপিত হয় এবং প্রচুর নথিপত্রাদি ও সামগ্রী দাখিল হয়েছিল;দেশনেত্রী লীলা রায়, সমর গুহ এবং আরও কয়েকজন নেতাজির ঘনিষ্ট সহযোগীর লেখা পত্রও৷ তাঁরা ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসের পবিত্র মোহন রায় এবং আরও কয়েকজন নেতাজি ঘনিষ্টরা যে প্রতিবছর ২৩ শে জানুয়ারী এবং দূর্গাপূজোর সময়ে গুমনামি বাবার কাছে যেতেন সেই মর্মে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যও এসেছিল ।

কিন্তু নেতাজি ও গুমনামি বাবার হাতের লেখা পরীক্ষা করে নয়াদিল্লীর জাতীয় পরীক্ষাগারের বিশেষজ্ঞ শ্রী বি লাল দুটি লেখা এক ব্যক্তিরই বলে অভিমত দিলেও সিমলার পরীক্ষাগারের দু’জন হস্তলিপি বিশারদ এবং কলকাতার ফরেনসিক ল্যাবরেটরির একজন বিশেষজ্ঞ ভিন্নমত দেওয়ায় এবং গুমনামি বাবা্র দাঁত অনুমানে মুখার্জি কমিশন কর্তৃক কোলকাতার সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরীতে পাঠানো রামভবনে পাওয়া কয়েকটি দাঁতের ডি এন এ পরীক্ষার নেতিবাচক রিপোর্টের প্রেক্ষিতে গুমনামি বাবাই নেতাজি কিনা প্রশ্নে কমিশন চুড়ান্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির (ক্লিনচিং এভিডেন্স) ‘অভাবে’র উল্লেখ করে কোনও সিদ্ধান্তে আসেননি৷ তবে মৃত গুমনামিবাবাই নেতাজি ছিলেন-এ তত্ত্বে সিলমোহরে দ্বিধাগ্রস্ত কমিশন অবশ্য এমন সম্ভাবনা খারিজও করে দেননি। অন্যদিকে কমিশনের রিপোর্ট ইউ পি এ সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অন্যায়ভাবে খারিজ করে দিলেও নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য বিষয়ে গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষন থেমে থাকেনি৷পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট মার্কিন হস্তলিপি বিশারদ কার্ল বাগেট নেতাজির হাতের লেখার সঙ্গে গুমনামি বাবার হাতেরলেখা( ১৯৬২ থেকে ১৯৮৫ এর মধ্যে পবিত্রমোহন রায়কে ১৩০টি চিঠি এবং অন্যান্যদেরও লেখা কিছু চিঠি) পরীক্ষা করে, দু’টি হাতের লেখা যে একই ব্যক্তির -এমনই অভিমত দিয়েছেন।

এতদসত্ত্বেও নেতাজি সংক্রান্ত অবশিষ্ট ৪১টি ফাইল প্রকাশ না করার অজুহাত হিসেবেও বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির আশংকার কথা বলা হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে কি সেই সত্য যা প্রকাশ করা যাবেনা স্বাধীনতার সাত দশকের অধিক কাল পরেও? নেতাজি সংক্রান্ত বাকি গোপন ফাইল প্রকাশ্যে আনলে কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি ও আন্তর্জাতিক সমস্যা্র উদ্ভব হতে পারে আবার জনৈক গুমনামি বাবার(যাঁকে নেতাজি অনুগামী ও অনুরাগীরা নেতাজি বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন) দাঁতের ডিএন এ টেস্টে্র ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলেও দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তার প্রভাব পড়বে এবং হিংসা ছড়িয়ে পড়তে পারে-এমন সরকারি ভাষ্য কিসের ইঙ্গিত দেয়-কোন সিদ্ধান্তে্র দিকে চালিত করে?৷ অন্যদিকে বিষ্ণু সহায় কমিশনে অধিকাংশ সাক্ষীর জবানবন্দীতে গুমনামিবাবাই যে নেতাজি প্রকাশ পেলেও দাখিলি অদ্ভুত রিপোর্ট এ অনুমেয় যে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী চক্র বিভিন্ন উপায়ে সত্য উদ্ঘাটনে ক্রমাগত বাধা ও অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে প্রায় সাত দশক ধরে৷

তবু কেউ কেউ যুক্তির অবতারনা করছেন বিশ্বে আলোড়ন আবার সৃষ্টিকারী এমন এক বিপ্লবী কি করে দেশের এইসমস্যার মাঝে একজন সাধু হয়ে আত্মগোপন করে থাকবেন?

প্রতিযুক্তিতে বলা যায় যে আরো একজন অগ্নিপুরুষ বিপ্লবীও যে সময়ের দাবিতে নিজের অনুভূতির তাড়নায় সন্ন্যাসের পথে অগ্রসর হয়ে দীর্ঘ জীবনযাপন করেছেন এমন দৃষ্টান্ত এদেশও আছে। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রও একসময় সন্ন্যাসী হওয়ার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেছিলেন। যুদ্ধের সেই উত্তাল সময়েও তিনি ব্যংককে থাকাকালীন প্রতিদিন গভীর রাতে রামকৃষ্ণমিশন এ যেতেন,জপতপের জন্য ছিল রুদ্রাক্ষের মালা।একথা সত্য তাঁর মতো বিপ্লবী দেশপ্রেমিক নিজের মুক্তির জন্য সন্ন্যাস নিয়ে শুধু পুজো-আর্চায় মগ্ন থাকবেন বা ভয়ে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে থাকবেন এ কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস্য।কিন্তু এও সত্য যে ভগনবানজী ওরফে গুমনামীবাবা যে নিছক এক পুজারী সন্ন্যাসী হয়ে নিচেষ্ট ছিলেন না তা অনুমান করাযায় রামভবন থেকে উদ্ধারীকৃত সামগ্রীর তালিকায় দৃষ্টিপাত করলেই। সমসাময়িক অনেক ঘটনার নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল বলে অনুমান কোন কোন মহলের।

প্রথম থেকেই নেতাজিকে বিমান দূর্ঘটনায় মৃত বলে দাবি করে আসা স্বাধীনোত্তর দেশের কর্ণধাররা,এমনকী আপন স্বার্থে সত্য গোপনের লক্ষ্যে দেশের শীর্ষ আদালতের কৃতী বিচারপতির সিদ্ধান্তও পত্রপাঠ ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা হয়নি যাদের সেই স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল ভবিষ্যতেও আপ্রাণ সচেষ্ট সক্রিয় থাকবে এই অপকর্মে৷ তবুও গোপন করে রাখা আরও বিভিন্ন তথ্য উদ্ধারের ফলে সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই৷তবে যেদিন ভয়ঙ্কর মিথ্যার পরদাফাঁস হয়ে প্রকাশ্যে আসবে তিনি বেঁচে ছিলেন তথাকথিত বিমান দূর্ঘটনার পরে বহু বছর অবধি হয়ত বহু কষ্টেও-‘ঘরে’ও ফিরেছিলেন সেদিন কিন্তু দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক পরিসরেও নিঃসন্দেহে এক বিশাল আলোড়ন উঠবে,সে বিস্ফোরনের অভিঘাত যে সুদূরপ্রসারী হবে তা বলাই বাহুল্য-তবে এতদিন ধরে চলা এক বিশাল এক অন্যায়েরও হয়ত অবসান সুচিত হবে৷

সময় কিন্তু দ্রুত প্রবহমান৷ অতএব এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজ এবং মতাদর্শ নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গতকারনেই উচিত সরকারের কাছে দেশের বরেণ্য এই সন্তান-অনন্য ইতিহাস পুরুষের,দেশবাসীর প্রিয়তম নেতার অন্তিম পরিণতির রহস্য উদ্ঘাটনে সঠিক সদর্থক পদক্ষেপ অবিলম্বে নেওয়ার জন্য দাবি করা।