আন্দোলনের পরে

এবার একটা অপ্রিয় সত্যি কথা বলার পালা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন শেষ হল। একথা অনস্বীকার্য, এই আন্দোলনের সাফল্য, তা সে আংশিক হোক বা পূর্ণাঙ্গ, সেই সাফল্যের পিছনে কিন্তু আছে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের লাগাতার সমর্থন। এই সমর্থন না পেলে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন কতটা সফল হয়ে উঠতে পারত সে বিষয়েও একটা প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। থেকে যায় তার কারণ, রাজপথে বসে এ রকমই এক দীর্ঘ আন্দোলনের সাক্ষী কিন্তু এই মহানগরই। সেই আন্দোলন বিভিন্ন স্তরের চাকুরিপ্রার্থী হবু শিক্ষক শিক্ষিকাদের। সেই আন্দোলনের পেছনে কিন্তু এই জনসমর্থন কখনোই মেলেনি। ফলে শাসকপক্ষও কখনোই আশঙ্কিত হয়নি, আতঙ্কিত হয়নি। ফলশ্রুতি, আন্দোলন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে, ফলপ্রসূ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয় না জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনের শক্তির উৎস কোথায়।

অপ্রিয় সত্যি কথাগুলি এসে যায় ঠিক এই জায়গা থেকেই। দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রায় এক ধরনের শত্রু-সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছেন ডাক্তার সম্প্রদায়ের এক বৃহত্তর অংশ। অভিযোগ অসংখ্য। কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে। সরকারি হাসপাতালগুলিতে এমার্জেন্সিতে রোগী নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, জরুরি, সংকটজনক অবস্থাতেও অনেক সময় কোনও ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া যায় না, অনেকসময় খোঁজ নিয়ে হয়তো দেখা যায় তাঁরা আড্ডা মারছেন, সে আড্ডা ছেড়ে উঠে আসতে তাদের ইচ্ছে করছে না, যদিও বা এলেন, ঝোঁক থাকে তাঁদের রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেওয়ার দিকে। অতঃপর ভর্তি যদি হতেও পারেন রোগী, শেষ পর্যন্ত তার গতি কি হবে, সঠিক সময়ে তার চিকিৎসা হবে কিনা, তার একমাত্র উত্তর ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিতে হয় রোগীর বাড়ির লোকজনকে। যদি ডাক্তারদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের প্রমাণ চাওয়া হয়, তাহলে তার একটিই উত্তর, অভিজ্ঞতা যখন প্রায় ‘গণ’-চরিত্রের, তখন তার কি কোনও প্রমাণ প্রয়োজন হয়?

হাসপাতালের অভিজ্ঞতা ছেড়ে দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় ফেরা যাক। ডাক্তারদের নাকি পেশা-প্রবেশের আগে সেবার শপথ নিতে হয়। অথচ আজ যদি আপনার বাড়িতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, যদি তাকে ডাক্তারের চেম্বার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তাহলেও কোনও ডাক্তারই সেই শপথবাক্য মনে করার চেষ্টাটি পর্যন্ত করবেন না, পদধূলি দেবেন না আপনার প্রাঙ্গণে। অথচ আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও পরিস্থিতি এমনটি ছিল না।


এর বাইরে অযথা অতিরিক্ত ওষুধ লেখা (ওষুধ কোম্পানিগুলির নানাবিধ প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে), প্যাথলজি সেন্টারগুলির সঙ্গে যোগসাজশে অযথা নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষার নির্দেশ দেওয়ার মত বহুবিধ রোগী-হেনস্থার কথা না হয় না-ই তুললাম।

তাই ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, যখন আপনারা আন্দোলন করছেন তখন কারা আপনাদের মাথায় ত্রিপলের ব্যবস্থা করেছেন, কারা না চাইতেই অজ্ঞাতকুলশীল থেকেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, বৃষ্টিতে ভিজছেন দেখে শুকনো জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করেছেন, খেয়াল করেছেন কি? তারা এই সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে হয়তো এমন মানুষও আছেন, যার বাবা বা মাকে আপনাদেরই কারও স্রেফ অবজ্ঞা ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হয়েছে। এই মানুষগুলিই কিন্তু আপনাদের আন্দোলনকে বিনা দ্বিধায় শুধু সমর্থন করতে এগিয়ে আসেননি, সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু কেন? ভেবে দেখেছেন কি? মনে হয়, দেখেননি। আসলে নিতান্তই সাধারণ মানুষ আমরা, যাঁরা আমাদের অসুস্থতার সময় পুনর্জীবন দান করেন, তাঁরা তো আমাদের কাছে ঈশ্বর-স্বরূপ। তাই তাঁদের হেনস্থা, তাদের অমর্যাদা, আমরা মেনে নিতে পারিনি।

কিন্তু এর বিনিময় আমরা চাই না। বরং দানের প্রতিদান হিসেবে নয়, যেটুকু আমাদের ন্যায্য এবং স্বাভাবিক প্রাপ্য আপনাদের কাছ থেকে, সেটুকুর প্রত্যাশা কি এবার আমরা করতে পারি? যদি না পারি, এই আন্দোলন যেটুকু সাফল্য লাভ করেছে, তা অচিরেই মুছে যাবে। কেননা সাফল্য তো সেই অর্থে খুব বড়ো কিছু পাওয়া যায়নি। কয়েকজন আধিকারিককে বদলি করা হয়েছে মাত্র (যে সব বদলি কবে সবার অলক্ষ্যে পাল্টে যাবে তা কেউ জানতেই পারবেন না, যেমন যায় নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কমিশনের নির্দেশে যে বদল করা হয়েছিল সেগুলির পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে), আর দেওয়া হয়েছে কিছু গালভরা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু আপনারা, আমাদের স্নেহভাজন জুনিয়র ডাক্তাররা, আপনারা কি ভাবছেন, মেডিকেল কলেজগুলির সংলগ্ন হাসপাতাল এবং অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলিতে, অন্য কিছু না হোক, নিম্নমানের ও অকার্যকর ওষুধ নিয়ে (যে চক্রের বিরুদ্ধে নাকি মুখ খুলে ছিলেন আপনাদেরই সেই সহপাঠিনী, যাকে নিয়ে আপনাদের এত আন্দোলন) যে অন্যায় ও অনৈতিক দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, অন্তত সেটুকুকে এই আন্দোলন ভাঙতে পারল বা পারবে?

উত্তরটা সম্ভবত নেতিবাচক। আর তাই যদি হয়, তাহলে বলব, যদি সত্যিই আপনারা চান, এই রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামো ও চিকিৎসকদের মর্যাদার পুনরুজ্জীবন, তাহলে হয়তো আপনাদের আবার পথে নামতে হবে। সেদিন সাধারণ মানুষের সহানুভূতি এবং সহযোগিতা একইভাবে পেতে গেলে কিন্তু বদল দাবি করে আপনাদের মানসিকতার পরিবর্তনও।

শেষ করব একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। একবার ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলাম নিজের কাজে। গিয়ে, এক‌ইসঙ্গে রথ দেখা আর কলাবেচা করব ভেবে চলে যাই এক ডাক্তারের কাছে, পুরোনো এক রোগ নিয়ে। ডাক্তারবাবু দেখলেন, ওষুধ দিলেন। উঠে আসছি, এমন সময় মন্তব্য করলেন, “আপ বেঙ্গল সে ইধার কিঁউ আয়ে হো ইলাজকে লিয়ে, আই ডোন্ট নো, বেঙ্গল মে হি তো বহুৎ আচ্ছে ডক্টরস হ্যায়।”

বড় সত্যি কথা। আমাদের ডাক্তারদের মেধা আছে, প্রজ্ঞা আছে, হারিয়ে গেছে শুধু একটি সহানুভূতিশীল মন। এই আন্দোলন যদি সেই হারিয়ে যাওয়া অমূল্য সম্পদটি ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে সেটিই হবে সবচে’ বড়ো পাওয়া।