আবার শিরোনামে আদানি

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

ভারতের বৃহত্তম সৌর প্রকল্পের জন্য সরকারি আধিকারিকদের ২ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে। এই প্রেক্ষিতেই আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে আমেরিকায়। মার্কিন বাজারে ‘আদানি গ্রিন এনার্জি’র ৬০ কোটি ডলার মূল্যের বন্ড ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠতেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে সংস্থা। এদিকে তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে মুখে খুলে সংস্থার তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, আমেরিকার বিচার বিভাগ এবং সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একটি ফৌজদারি এবং একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেছে। নিউ ইয়র্কের জেলা আদালতে মামলাগুলি দায়ের হয়েছে। তাতে সংস্থার বোর্ড সদস্য গৌতম আদানি ও সাগর আদানির নাম থাকায় বন্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আমেরিকায় ভারতীয় পদস্থ আধিকারিকদের আদানি গোষ্ঠীর ঘুষ দানের অভিযোগ ওঠার পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দেশের রাজনৈতিক মহল তোলপাড়। দু’বছর আগে মার্কিন শর্ট সেলিং সংস্থা হিন্ডেনবার্গের এক রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। কারণ, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছিল যে বিপুল পরিমাণ বেআইনি আর্থিক লেনদেন করেছে গৌতম আদানির সংস্থা । এবার খোদ গৌতম আদানিকেই ঘুষ কাণ্ডে অভিযুক্ত বলে ঘোষণা করল মার্কিন আদালত। গৌতম আদানির ভাইপো সাগর আদানি এবং সংস্থার বোর্ডের আরও ৬ জন অধিকর্তা ভারতের সরকারি অফিসারদের ঘুষ দিয়েছে যাতে তারা রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থার সঙ্গে সৌর বিদ্যুতের চুক্তি করতে পারে। ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই ঘুষ দেওয়া হয়েছে।


প্রশ্ন হল, ভারতের সরকারি কর্তাদের ঘুষ দেওয়া হলে মার্কিন আদালত কীভাবে তা বিচার করতে পারে? আমেরিকার আদালত এই কারণেই তা করতে পারে যে আদানি গোষ্ঠীতে মার্কিন বিনিয়োগকারীরাও টাকা ঢেলেছে। উৎকোচ বা ঘুষ দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে মার্কিন আদালত বরাবরই স্পর্শকাতর। কারণ এর অর্থ হল উপভোক্তা, বিনিয়োগকারী বা সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে অসাধু উপায়ে কাজ হাসিল করা। মার্কিন আদালতের বক্তব্য, ঘুষ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি হাসিলের বিষয়টি মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ব্যাঙ্কের কাছে গোপন রেখেছিল আদানি গোষ্ঠী। তারা ভেবেছিল এই চুক্তি থেকে ২ বিলিয়ন ডলার তথা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করবে।
আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঠিক যে সময়ে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সেই সময়ে এই সংস্থা ভারতেও বিতর্কের মধ্যে । কারণ, ততদিনে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আদানির ভারতের ব্যবসা থেকে টাকা তুলে বিদেশে ভুয়ো কোম্পানিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পর সেই টাকা আবার আদানি গোষ্ঠীতে বিদেশি বিনিয়োগ হিসাবে দেখানো হয়েছে। তার মাধ্যমে আদানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। হিন্ডেনবার্গের ওই রিপোর্টের পর আদানির শেয়ারের দামে ধস নেমেছিল।

এবার বিষয়টা আরও জটিল। আদানি এনার্জি কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেন গৌতম আদানি। তাঁর ভাইপো সাগর আদানি হলেন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। সেই কারণে সৌর বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের অভিযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে মার্কিন আদালত। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন অ্যাজিওর পাওয়ারের সিইও রঞ্জিত গুপ্ত এবং সেই সংস্থার পরামর্শদাতা রূপেশ আগরওয়াল। তারা মার্কিন ইস্যুয়ার হিসাবে কাজ করেছিলেন। মার্কিন আদালতের অভিযোগ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াকে ১২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চুক্তি সম্পন্ন করতেই ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। অথচ দেখা যায়, ওই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারতে সৌর বিদ্যুৎ বিক্রি করার জন্য কোনও ক্রেতাই পায়নি। কোনও ক্রেতা ছাড়া সেই চুক্তি এগোবে কীভাবে? অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ক্রেতা ঠিক না করে যেমন ঝুঁকি নিয়ে চুক্তি করেছে, তেমনই আদানি গোষ্ঠীও ঝুঁকি নিয়ে চুক্তি করেছে।রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্খাটি যাতে রাজ্যের বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থাগুলিকে সৌর বিদ্যুৎ কিনতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে সেই কারণে সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার কর্তাদের মোটা টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এও অভিযোগ, অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সরকারি সরবরাহ সংস্থার কর্তারাও এর সঙ্গে জড়িত।

মার্কিন আদালত জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী ও মার্কিন ইস্যুয়ার- অ্যাজিওর পাওয়ারের সিইও ভাগাভাগি করে ঘুষের টাকা দিয়েছে। মার্কিন অভিযোগকারীদের আরও বক্তব্য, ষড়যন্ত্রকারীরা নানা কোড নেম ব্যবহার করতেন। এনক্রিপ্টেড ল্যাঙ্গুয়েজে মেসেজের আদানপ্রদান হত। যেমন গৌতম আদানিকে বলা হত, ‘দ্য বিগ ম্যান’ বা ‘নিউমারো উনো’। কীভাবে ঘুষের টাকা দেওয়া হয়েছিল, তাও জানা গিয়েছে বলে দাবি। অভিযোগ হল, কখনও প্রকল্পের অংশীদার করে কখনও পরামর্শদাতার ফি হিসাবে দেখিয়ে ঘুষ দেওয়া হয়েছে।

গৌতম আদানির ব্যবসার প্রকৃত চেহারা কী? বর্তমানে গৌতম আদানি এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটসকেও ছাপিয়ে গেছেন। কিন্তু সবটাই কাগজে কলমে, ভিতরে বিস্তর গোলমাল। আন্তর্জাতিক সংস্থা CreditSights-এর রিপোর্ট বলছে, আদানি গোষ্ঠী বিপুল পরিমাণ ঋণে জর্জরিত। নিজের সংস্থাকে বড় করার নেশায় গৌতম আদানি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত সংস্থায় পরিণত করেছেন। ভারতের সব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা তাঁর পাওনাদার। ভারতে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণকারী সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজ, যে সংস্থার শেয়ারের মূল্যের উপরে ভিত্তি করেই গৌতমের বিত্ত। বিরোধীদের অভিযোগ,সেই সংস্থার প্রায় গ্যারান্টার হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এটাই ওঁর গুজরাট মডেল।

এখন আদানি গোষ্ঠীর কিছু বিনিয়োগ লক্ষ করা যাক:
(১) আদানি গোষ্ঠী সুইটজারল্যান্ডের কোম্পানি হোলসিম গ্রুপকে ১০.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে রাতারাতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সংস্থা হয়ে গেছে, অথচ এদের সিমেন্ট তৈরির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
(২) ইজরায়েলের হাইফা বন্দরকে ১.১৮ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে।
(৩) অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল কয়লা খনি কিনে নিয়ে পরিবেশ সম্পর্কিত বিরাট বিতর্ক তৈরি করেছে।
(৪) তারা নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচগুণ বাড়াতে চায়। তাই গ্রীন হাইড্রোজেন, এয়ারপোর্ট, কয়লা, এলুমিনা, কপার শুদ্ধিকরণ, ডেটা সেন্টার, পিভিসি ক্ষেত্রে বিরাট বিনিয়োগ করছে।

কোথা থেকে আসছে বিনিয়োগ করার মত এত টাকা? হাওয়া থেকে বললেই ভাল হয়। একটি টাকাও নিজস্ব তহবিল থেকে বেরোচ্ছে না। সবটাই চলছে ঋণ থেকে। এবং তারা এই বলে লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করছে যে বহু দেশি, বিদেশি সংস্থা তাদের প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এই আদানি গোষ্ঠী নামক চোরাবালির উপরে ভরসা করেই মোদী নতুন ভারত নির্মাণ, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

নয়া উদারনীতিতে কর্পোরেটদের নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়া, বেল আউটের নামে সরাসরি অর্থসাহায্য দিয়ে আমজনতার জন্য রাষ্ট্রের বরাদ্দ কমানো হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নামমাত্র কর দেওয়ার জায়গাগুলোকে ব্যবহার করে কর্পোরেটগুলোর কোটি কোটি টাকা কর ‘আইনসম্মতভাবে’ ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ওইসব ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’-এ কোম্পানি খুলে অর্থ চালান করা হয়। আবার ঘুরপথে সেই অর্থই নিজের দেশে বিনিয়োগ করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ, ধোঁয়াটে। ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ হয় সিঙ্গাপুর থেকে, তৃতীয় স্থানে রয়েছে মরিশাস। সিঙ্গাপুরে কর্পোরেট করের হার কম, মূলধনী লাভে কর দিতে হয় না। তাই সেখানে কোম্পানি খুলে ঘুরপথে এদেশে বিনিয়োগ করার সুবিধে রয়েছে। মরিশাসেও এই করের হার নগণ্য। কর্পোরেটদের সুযোগ দেওয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুর্নীতি, কারচুপি। আদানির মত কর্পোরেটগুলো যার অংশীদার।

এইসব কারচুপিতে সরকারের রাজস্ব কমে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানিগুলো সঙ্কটে পড়ে। ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থার অর্থ মানে আমজনতার অর্থ। তা ঘুরপথে যায় কর্পোরেটের হাতে। ঋণশোধ না করার তালিকাতেও কর্পোরেট সংস্থাগুলোই সামনের সারিতে থাকে। ঋণ আদায়ের বদলে ঘুরপথে তাদের ঋণ মকুব করা হয়। যার অন্যতম কৌশল হল, অনাদায়ী ঋণ মুছে দেওয়া, যার পরিভাষিক নাম ‘ব্যাড ডেট রাইট অফ’।

অতএব আদানি সম্বন্ধে অভিযোগ বহুমুখী। একে তো শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো বেআইনি। তার উপর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, এলআইসির মত সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার সময়ে শেয়ার বন্ধক রেখেছেন। ঋণ নেওয়ার সময়ে বন্ধক হিসাবে জাল সোনা জমা দেওয়ার মতই শেয়ারের দাম বাড়ানোয় নিজে জড়িত থাকা মানে ব্যাঙ্কের সঙ্গে জালিয়াতিও করা হয়।

প্রশ্ন হল, আদানির এত লক্ষ কোটি টাকা ধার নেওয়ার দরকার পড়ল কেন, আর তার বন্ধক জোগাড় করতে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়াতেই বা হল কেন?