নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ পরিবহন, কয়লা খনি, এনার্জি পার্ক, ডাটা স্টোরেজ কেন্দ্র, ভোজ্য তেল, নিউজ চ্যানেল, বিমানবন্দর, এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাবি পুনর্গঠনের নামে বিশাল জমি ইত্যাদি ব্যবসাতে আদানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ধনকুবেরদের তালিকা প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা হুরুনের বার্ষিক রিপোর্ট অনুসারে ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় আদানির সম্পদ ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা আর ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর সম্পদ ৫৭ শতাংশ কমে হয়েছিল ৪.৭৪ লক্ষ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসাবে ৫৭ শতাংশ কমার আগে সম্পদ ছিল ১০.২ লক্ষ কোটি টাকা।
নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে আদানিরও সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৮ সালে মহেন্দ্র বাদার্সের কোম্পানিতে একজন হীরা বাছাইকারী হিসাবে পেশা শুরু করার পর নিজের দাদার প্লাস্টিক শিল্পে কাজ শুরু করেন আদানি। এরপর আটের দশকের শেষের দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসা ও রপ্তানির কারবার শুরু করেন। ২০০২ সালে গুজরাতে নারকীয় দাঙ্গার পর ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’-এর নামে শিল্প সম্মেলন সংগঠিত করে কলঙ্কিত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উন্নয়নের মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নেন গৌতম আদানি। এর ফলে মোদীর সঙ্গে গৌতম আদানির অটুট বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গুজরাতে মুন্দ্রা বন্দরের জন্য মোদী ১৪০ স্কোয়ার মাইল জমি নামমাত্র মূল্যে প্রতি স্কোয়ার মিটার এক টাকা থেকে ৩২ টাকায় দিয়ে দেন। মোদী তাঁর বন্ধুকে আরও লাভ পাইয়ে দিতে মুন্দ্রা বন্দরকে স্পেশাল ইকনমিক জোন হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালে লোকসভার গোটা নির্বাচনী প্রচারে আদানির ব্যক্তিগত জেট বিমানে নরেন্দ্র মোদী সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছিলেন এবং শপথ নিতে গিয়েছিলেন আদানির জেট বিমানে। ২০১৪ সালের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনেক বিদেশ সফরের সঙ্গী ছিলেন আদানি। যেসব দেশে মোদী যেতেন, সেইসব দেশে লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তি পেতেন গৌতম আদানি। অস্ট্রেলিয়া সফরে আদানিকে বিদেশে সর্বোচ্চ ঋণ ১ বিলিয়ন ডলার মঞ্জুরের উদ্দেশ্যে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন চেয়ারপার্সনকেও সফরসঙ্গী করেছিলেন মোদী।
মোদী-বান্ধব ধনকুবের গৌতম আদানি ও তাঁর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষ এবং জালিয়াতির অভিযোগে আমেরিকা প্রশাসনের মামলা দায়েরের ঘটনা সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। ভারতীয় আধিকারিকদের ২০১৯ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র বরাতের রফা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপন করা এবং ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে সৌর প্রকল্প সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে আদানি গোষ্ঠীর ২০০ কোটি ডলার সংগ্রহের অভিযোগ এনেছে আমেরিকার সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। বাজারের থেকে অনেক বেশি দামে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির বরাতের জন্য ২০১৯ কোটি টাকা সরকারি আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে অন্ধ্র, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ু এবং জম্মু-কাশ্মীরে বরাত পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী। অভিযোগে নাম জড়িয়েছে দিল্লির অ্যাজিওর পাওয়ার সংস্থার।
২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে মরিশাস, বারমুডা ইত্যাদি দেশে আদানি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শেল কোম্পানির মাধ্যমে জালিয়াতি করে শেয়ারের দাম বাড়াবার কৌশলের অভিযোগ ছিল। এই জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর আদানির তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামে ব্যাপকভাবে পতন হয়েছিল। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, ‘আদানি গোষ্ঠী বারবার দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং এবং করদাতার তহবিল তছরুপের অভিযোগের মুখোমুখি হলেও তদন্ত আটকে দেওয়া হয়েছে।’ আদানির কোম্পানিতে জীবনবিমার শেয়ারে লগ্নি একদিনেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিল ২৩,৫০০ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্ট সেবিকে তদন্তের ভার দিলেও আজ পর্যন্ত তদন্ত সমাপ্ত হয়নি। কারণ সেবির চেয়ারপার্সন মাধবী পুরী বুচ ও তাঁরস্বামী দাভাল বুচ আদানির বিদেশি অংশীদারত্বে অর্থ লগ্নি করেছে। অথচ এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতও নীরব।
আদানির নাম উচ্চারিত হলেই মোদী-বিজেপি-আরএসএস, এমনকি সংসদ পরিচালকরাও আলাচনা বন্ধ করে দেন। মোদী এবং আদানির মধ্যে কোনও পার্থক্যই করা যাচ্ছে না। দুই বন্ধুর লুটতন্ত্র চলছে এখন দেশে।