মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সল্টলেকে বেসরকারি বাসের ধাক্কায় ১১ বছরের এক স্কুলপড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে বেদনাহত। যখন এই দুর্ঘটনা ঘটে, তখন মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং সফর করছেন। সেখান থেকে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এক নির্দেশ পাঠিয়ে বলেন, অবিলম্বে একটি বৈঠক ডেকে কী করে এই দুর্ঘটনা রোধ করা যায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। সেই মতো সম্প্রতি উন্নয়ন ভবনে পুলিশ ও পরিবহন দফতরের বৈঠক বসে। এই বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর বেসরকারি বাসের রেষারেষির জন্য এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে চালু কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কথা হয়। যদিও এই বৈঠকে এ ব্যাপরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। হয়তো এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কী, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বেসরকারি বাসের রেষারেষির জন্য দুর্ঘটনা নতুন নয়— এর আগেও শহরে এর কারণে দুর্ঘটনায় পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যে পথদুর্ঘটনার বহর বেড়ে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফের স্লোগান দিয়েছিলেন। সারা রাজ্যে তার প্রচার চলে। এতে কতটা সতর্ক হয়ে বেসরকারি বা সরকারি বাস চালকরা বাস চালিয়েছেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও মুখ্যমন্ত্রীর এই স্লোগান সাড়া জাগিয়েছিল। প্রাইভেট গাড়ির চালকরা সতর্ক হয়েছিল— সরকারি ও বেসরকারি বাসের চালকরাও পুলিশের নজরদারি উপেক্ষা করতে পারত না। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই স্লোগানের মমার্থ ভুলতে চলেছে বাসচালকরা। এখন আবার বাস চালকদের গাড়ি চালাতে রেষারেষি শুরু হয়েছে। আর এই রেষারেষির বলি হল একজন স্কুলপড়ুয়া। মা তাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। পথে দুই বাসের রেষারেষির কবলে পড়ে যে যানে আসছিল তাকে সজোরে ধাক্কা মারে এক বাস। ফলে যানটি উল্টে পড়ে। মা আহত না হলেও শিশুটি গুরুতর আহত হয়। তারপর মৃত্যু।
পরপর এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও সচেতন হয়নি বাসচালকরা। বৃহস্পতিবারও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ট্রেলার ধাক্কা মারে এক স্কুল গাড়িকে শহরেরই এক রাস্তায়। এই ধাক্কায় একজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মারাত্মক জখম হয়, তাকে সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সুতরাং এমন দিন খুব কমই যাচ্ছে যে শহরে বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে না কেউ। কেউ হয়তো জীবন হারাচ্ছে, কেউ হয়তো গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি বাস সংগঠনের কর্তাদের কোনও হুঁশ নেই। সরকারের নিয়ম কানুনের কোনও তোয়াক্কা করে না তারা। ট্রাফিক আইন ভেঙে বাস নিয়ে চলে যায়। পুলিশ অসহায় হয়ে তা দেখে। পথচারীরা ফুটপাত দখল হওয়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করে।
বাইক চালকদের মধ্যেও সাবধানতার বড় অভাব। তারা ট্রাফিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গাড়ি চালায়। চালকের মাথায় হেলমেট আছে, কিন্তু তিনি সামনে ও পিছনে ছেলেমেয়ে বসিয়ে বাইক চালাচ্ছেন দুর্বার গতিতে। ছেলেমেয়ের মাথায় হেলমেট নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে বাইকচালক হয়তো বেঁচে যাবেন, মাথায় চোট পাবেন না হেলমেটের জন্য। কিন্তু অন্য আরোহীরা হেলমেট না থাকার জন্য গুরুতর জখম হতে পারে। মৃত্যুও ঘটতে পারে। পুলিশের নজর এড়িয়ে বাইকচালকরা এইভাবে তাদের গাড়ি চালায়। নিয়ম হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো যাবে না। এবং সেই বাইকের পিছনে অন্য কাউকে বসালে তার মাথায়ও হেলমেট থাকতে হবে। কিন্তু সেই আইন এখন শিথিল হওয়ার পথে। পুলিশের সামনেও বাইকচালকরা মাথায় হেলমেট ছাড়া বাইক চালাচ্ছে। পুলিশ দেখেও দেখে না। কলকাতা পুলিশ তবুও কিছুটা হেলমেটহীন বাইকচালকদের ধরে রাখে, রাজ্য পুলিশ এলাকায় বাইকচালকরা কোনও নিয়মের ধার ধারে না।
তদুপরি নিয়ম ছিল হেলমেটহীন বাইক নিয়ে কেউ পেট্রোল পাম্পে গেলে তাকে জ্বালানি দেওয়া হবে না। বাস মালিকদেরও এ ব্যাপারে সরকার সতর্ক করেছে। কিন্তু এখন সেই নিয়ম আর নেই। হেলমেটহীন বাইকচালক পাম্পে গিয়ে তেল নিয়ে আসছে—কিন্তু পাম্পের মালিক হেলমেট না থাকার জন্য কিছু বলছে না। বাইকচালকরা বেপরোয়াভাবে তাদের গাড়ি চালায় ট্রাফিক আইন ভেঙে। পুলিশও হেলমেটহীন বাইক চালককে কিছু বলে না। হেলমেট না থাকলে পুলিশ মোটর যান আইনের ১২৮ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারে। এমনকি বিধি ভাঙলে এক হাজার টাকা জরিমানাও করতে পারে।
সল্টলেকের দুর্ঘটনার পরও পুলিশের ঢিলেমে দূর হয়নি। কলকাতা একটি জনবহুল শহর। রাস্তা যা আছে, তাও বেশির ভাগ হকারদের কন্ট্রোলে। বাম সরকারও হকার সমস্যার কোনও সমাধান করতে পারেনি— বর্তমান তৃণমূল সরকারও এ কাজে ব্যর্থ। সুতরাং কলকাতা শহরের রাস্তায় হাঁটতে গেলে জীবন হাতে নিয়েই হাঁটতে হবে।