পাশফেল প্রথা তুলে দেওয়ায় শিক্ষার্থী পাশ করলেও তার শিক্ষা ব্যবস্থাই ফেল করে

স্কুলছুট যাতে না হয় তার জন্যে পরীক্ষায় ফেলের ধারণাই মুছে দেওয়ার আয়োজন করা হয়। তাতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা অনায়াসেই পাশ করে, অথচ তার শিক্ষা ব্যবস্থাই ফেল করে বসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের শিক্ষার অধিকারে ‘নো ডিটেনশন পলিসি’ শুরু হয় ষোলো বছর আগে ২০০৯-এ। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ফেল করলেও নতুন ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ছকবন্দি পাশফেলের ধারণাই তুলে দেওয়া হয় যাতে সবাই পাশ করে। তার লক্ষ্যেই ছিল সবার শিক্ষার অধিকার ও তার বিস্তার সুনিশ্চিত করা। ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া বা ফেলের ভয়ে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা যাতে সক্রিয় হতে না পারে,তার জন্যই সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়ার নির্দেশিকা জারি হয়েছিল। তাতে স্বাভাবিক ভাবেই পক্ষে বিপক্ষের মতে বিতর্ক দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, শিক্ষার মান নিয়েও বহুবিধ প্রশ্নের অবতারণা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

সেক্ষেত্রে অবাধে শিক্ষার বিস্তারে যে তার লক্ষ্য পূরণে নিশ্চয়তারই অভাব ছিল,পরবর্তীতে ২০১৯-এ অর্থাৎ দশ বছর পরে সেই শিক্ষার অধিকার আইন সংশোধনের উদ্যোগেই তা প্রতীয়মান। এজন্য রাজ্যগুলোর উপরেই পাশ-ফেল ব্যবস্থা চালু রাখা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব থেকে হাত তুলে নিলেও তা আর পুরনো পাশফেল প্রথায় ফিরে আসেনি। বিষয়টি যে শিক্ষাক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি,সে-বিষয়ে দীর্ঘ টালবাহানা থেকে দড়িটানাটানিতেই তা প্রতীয়মান। ২০২৪-এর ২৩ ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকারের পুনরায় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার ঘোষণাতেই সেই দোলাচলতা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস প্রকট হয়ে ওঠে। আপাতভাবে মনে হবে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখো করাতেই তার আয়োজন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার প্রসারে দারিদ্রপীড়িত দেশে পাশফেল প্রথা তুলে দিয়ে সবাইকে পাশ করানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, যেখানে প্রতিযোগিতার বালাই নেই, সেখানে অবাধ বিচরণের সদিচ্ছায় পড়াশোনায় কোনওরকম অনীহাবোধ জেগে না উঠাই দস্তুর। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে আরও চাহিদা পূরণের প্রয়াস জারি শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। মিড-ডে মিল, বইপত্র থেকে বিদ্যালয়ের পোশাক ও আরও নানাবিধ সরকারি সুযোগসুবিধার নিবিড় আয়োজন সেখানে। একে সবাই পাশ,তার উপরে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু উপহার হিসেবে পাওয়ার আনন্দ। অথচ তাতে আয়োজনের ফুল প্রয়োজনের ফলে পরিণত হতে পারেনি বা পারে না। আসলে শিক্ষা দানের বিষয় নয়,গ্রহণ বা অর্জনের অমূল্য সম্পদ। সেক্ষেত্রে ছাত্রের দারিদ্রমোচন করে নিশ্চিত পাশের বন্দোবস্তেই শিক্ষার বিস্তার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাতে স্বাক্ষরতার হার বাড়ে, সাক্ষরতার হারও বাড়িয়ে দেখানো যায়,কিন্তু শিক্ষার বিস্তার ঘটে না।

আসলে শিক্ষার সঙ্গেই পরীক্ষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরীক্ষার গুরুত্বেই শিক্ষার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুরুত্বকেই লঘু করে অকেজো করলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। পরীক্ষার লক্ষ্যে থাকে যাচাই আর বাছাই। প্রথমটির সঙ্গেই থাকে দ্বিতীয়টির যোগ। কতটা শিক্ষা হল থেকে সেই শিক্ষার পরবর্তী ধাপে উত্তরণ বিষয়ে মূল্যায়ন করাই সেই পরীক্ষার লক্ষ্য প্রসারিত হয়। সেক্ষেত্রে যাচাইকে গুরুত্ব না দিলে যাচাই যাচ্ছেতাই-এ পরিণত হয়, যা চাই তা কখনওই মেলে না। সেক্ষেত্রে বাছাই করার প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক ভাবেই প্রবেশ অবাধের ছাড়পত্রে পরীক্ষা ব্যবস্থাটাই অসার হয়ে পড়ে। পরীক্ষা থাকবে আর তাতে পাশফেল থাকবে না বা সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে,এ রকমের ধারণাই অশিক্ষামূলক। সেখানে তো শুধু নম্বর তোলার প্রতিযোগিতাই থাকে না,তাতে শিক্ষার্থীর আত্মসমীক্ষারও অবকাশ মেলে। নম্বরের ইঁদুরদৌড়ে কৃতিত্ব জাহিরের বাইরেও পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সেক্ষেত্রে কী শিখলাম বা জানলাম থেকে কত শেখা বাকি বা কত অজানা থেকে গেছে তা নিয়ে ওয়াকিবহাল হওয়াটাও জরুরি। তাতে ব্যর্থতার সোপান বেয়ে সাফল্যে পৌঁছানোই তার লক্ষ্য নিঃস্ব হয়ে পড়ে না। তাতে নিজেকে আবিষ্কার করার ক্ষেত্রেও অসফলতা বিষয়ে আত্মসচেতনতাও জরুরি। শিক্ষা তো শুধু কত কিছু জানির পরিচয় নয়, কত কিছুই জানি না’র আবিষ্কারও। সেক্ষেত্রে পরীক্ষায় ফেলের ভীতি দূর করে শিক্ষার বাধা দারিদ্রকে চিহ্নিত করলে তার সমাধান করা সহজ হয়, কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ তাতে বাড়ে না, বরং পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন করে তার আকর্ষণহীনতার দূরত্ব বেড়ে চলে,শিক্ষা নেওয়ার সদিচ্ছাই হারিয়ে যায়। এমনিতেই যা পরীক্ষায় আসে না,তার প্রতি শিক্ষার্থীর মনোযোগ থাকে না। সেখানে যে শিক্ষা পরীক্ষায় জরুরি নয়,তার প্রতি অনাগ্রহ অত্যন্ত স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার জুজু কাটিয়ে স্কুলছুটে রাশ টানার সিদ্ধান্তটি সাফল্য পেতে পারে না, তা পুনরায় পরীক্ষার প্রচলিত প্রথা ফিরিয়ে আনাতেই প্রতীয়মান। সেক্ষেত্রে শুধু পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেই নয়, সুবিধাজনক যে পদ্ধতিতেই হোক,প্রথম শ্রেণি থেকে সব ক্লাসেই পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।


পাশফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে সবচেয়ে যে জোরালো যুক্তিটি সেদিন উঠে এসেছিল,তা হল পাশফেলের দৌরাত্ম্যে গরিব ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা আরও বেশি স্কুলছুট হয়ে পড়বে, শিক্ষা থেকে পিছিয়ে যাবে। কথাটা যে অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক,ইতিমধ্যেই তার পরিচয় প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের রাজ্যে ২০২০ থেকে পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখে ফেল না করিয়ে পাশ করানো হলেও স্কুলছুটের প্রবণতা এখনও জারি। অন্যদিকে পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখে বেসরকারি স্কুলের আকর্ষণ ও বিস্তার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার ব্যবস্থা অত্যন্ত নিবিড়। সেক্ষেত্রে পরীক্ষা অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থাই অকেজো হয়ে ওঠে। পরীক্ষা অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় শিক্ষকের নিয়মিত ক্লাস করা, সযত্নে পাঠদান করা, সিলেবাস শেষ করা থেকে শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করা সর্বত্র অনাগ্রহ ও অনীহা প্রকট হয়ে ওঠায় শিক্ষানিকেতনটাই নিয়ম রক্ষার অফিসে পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষার সঙ্গে পরীক্ষাকে আকর্ষণীয় করে শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন করা জরুরি। তাতে মাথা ব্যথা হলে মাথা না কেটে তার ওষুধ সন্ধানের মতো পরীক্ষা ব্যবস্থাকেই আরও মনোগ্রাহী ও আকর্ষণীয় এবং সময়োপযোগী করে তুললে আখেরে শিক্ষার আলোতে শিক্ষার্থী তার নিজের জীবনের পথ খুঁজে পাওয়ার স্বার্থেই স্কুলমুখো হবে।