রাজু পারাল
রঙ ও রেখার এক আশ্চর্য যাদুকর ছিলেন তিনি। দর্শকের কাছে তিনি পরিচিত ‘ছবির রাজা’ হিসেবে। শিল্পের প্রতি অনুরাগই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল দক্ষতার শীর্ষে। হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)। সমকালে তিনি যে অতুলনীয় চিত্রকলার সৃষ্টি করেছিলেন তা আজও শিল্প রসিক ব্যক্তিদের মুগ্ধ করে। তাঁর ছবি ভাবের অপূর্ব অভিব্যক্তিতে চোখ ও মনকে অভিভূত করে। মৃত্যুর ১৫০ বছর পরে আজও তাঁর আলোচনা প্রাসঙ্গিক।
নবজাগরণের পীঠস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট (বাংলা: ১২৭৮, ২৩ শ্রাবণ) বেলা ১২ টায় জন্মাষ্টমীর দিন অবনীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র গিরীন্দ্রনাথের পৌত্র। অবনীন্দ্রনাথের পিতা গুনেন্দ্রনাথ ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন সৌখিন ও সৌন্দর্য রসিক মানুষ। অবনীন্দ্রনাথের বড়দাদা গগনেন্দ্রনাথ ও ছোটবোন সুনয়নী দু’জনেই ছিলেন সেকালের নামজাদা চিত্রাশিল্পী। তাঁর মেজদা সমরেন্দ্রনাথের খ্যাতি ছিল শিল্পরসিক হিসেবে। এরকম পরিবেশে বড় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই শিল্পের প্রতি অবনীন্দ্রনাথের সহজাত আকর্ষণ গড়ে ওঠে শিশু কাল থেকেই।
ছেলেবেলা থেকেই অবনীন্দ্রনাথের মনটা ছিল ‘চোখে ভরা’। যা-কিছু দেখতেন যা কিছু ভাবতেন সবই তাঁর মনে ছবি হয়ে উঠত, আর তাঁর কথার মধ্যে ফুটে উঠত সেই ছবির ব্যঞ্জনা। তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিকথা কতকটা বাস্তব, আর কতকটা মিশে আছে তাঁর বালক মনের কল্পনা। বাল্যকালে তাঁর সবচাইতে কাছের মানুষটি ছিলেন-পদ্মদাসী। বৃদ্ধ বয়সেও অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিজুড়ে ছিলেন এই মানবী। বাল্যস্মৃতি ‘আপন কথা’য় বলেছেন:
‘‘আলোর কাছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পদ্মদাসী মস্ত একটা রূপোর ঝিনুক আর গরম দুধের বাটি নিয়ে দুধ জুড়োতে বসে গেছে—তুলছে আর ঢালছে সেই তপ্ত দুধ। দাসীর কালো হাত দুথ জুড়োবার ছন্দে উঠছে নামছে, নামছে উঠছে।’’
বাল্যকালে পদ্মদাসীকে ছাড়া একদণ্ডও চলত না অবনীন্দ্রনাথের। সকালে ঘুম ভাঙানো থেকে রাতে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত তাঁর সব কাজের দায়িত্বেই ছিল পদ্মদাসীর।
বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিশুমনের খেয়ালি কল্পনার কত ছবিই না ছড়িয়ে ছিল তাঁর আঁকা ও লেখায়। একা ঘরে বসে দেখতেন বিভিন্ন ধরনের ছবি। চোখে পড়তো দেওয়ালে টিকটিকি ওৎ পেতে আছে, চড়ুই বাসা বাঁধছে, চিল চুপ করে বসে আছে, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে, দেওয়ালে হেঁটে চলেছে মানুষের ছায়া। দুপুরে ছোট পিসির ঘরে ঢুকে তন্ময় হয়ে দেখতেন দেওয়ালে ঝোলানো দেবদেবীর পট, অয়েল পেন্টিং আর কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতেন ‘শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘মদনভস্ম’, ‘কাদম্বরী’।
‘নয়’ কি ‘দশ’ বছর বয়সে সপরিবারে একবার কোন্নগরের বাগান বাড়িতে গেলেন তাঁরা। সেখানেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলো। কাগজ-পেন্সিল-তুলি-কলম নিয়ে বসে পড়লেন অবনীন্দ্রনাথ। কলসি কাঁখে মেয়েরা নদীর ঘাটে যাচ্ছে, ছেলেরা পাঠশালায় চলেছে, রাখাল বালক গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে, মুদির দোকান, বাঁশঝাড়, রথতলা, ধান খেত, নদীর বুকে ভাসমান নৌকা-এসব দেখলেন আর আঁকলেন। আসলে ছবি আঁকার আবহ তাঁর বাড়িতেই ছিল। তাই উপলব্ধির জগৎ ও মনের সঞ্চয় তাঁর বেড়েই চলল। মা-সৌদামিনীর প্রতি অবনীন্দ্রনাথের ছিল গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তি। অবনীন্দ্রনাথ বাল্যকালে আঁকার প্রেরণা মায়ের কাছ থেকেই পান।
অবনীন্দ্রনাথের প্রথাগত অঙ্কন শিক্ষার শুরু ২৫-২৬ বছর বয়সে। পারিবারিক বন্ধু কুমুদ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ইতালিয়ান শিল্পী গিলার্ডির। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে শিখলেন প্যাস্টেল, তেল রং, প্রতিকৃতি আঁকা। ছ’মাস শেখার পর বন্ধ করলেন গিলার্ডির কাছে আঁকা শেখা। বাড়িতেই ছবি আঁকবেন বলে স্টুডিও খুললেন। উৎসাহ দিলেন কাকা রবীন্দ্রনাথ। সে সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে আসেন কেরলের বিখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা। তিনি অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলির প্রভূত প্রশংসা করেন।
১৮৯৩ সালে ইংরেজ শিল্পী সি.এল. পামারের কাছে শুরু করেন শিক্ষানবিশি পর্ব। পামার সাহেবের কাছে শিখলেন জল রঙ, কালি-কলম ও তেল রংয়ের পদ্ধতি। ইউরোপীয় কায়দায় ছবি আঁকায় দক্ষ হয়ে উঠলেও অবনীন্দ্রনাথের মন সর্বদাই অতৃপ্তিতে ভুগত। দেশিয় ছবির সূক্ষ্ম কারুকার্য, ঔজ্জ্বল্য এবং বর্ণ সমাবেশ তাঁর মনকে এমন ভাবে আকৃষ্ট করল যে তিনি দেশিয় রীতিতেই ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নেন শেষ পর্যন্ত। নব-উৎসাহে এঁকে চললেন—‘বৈষ্ণব পদাবলী,’ বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি।
১৮৯৭ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সরকারি আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ হ্যাভেলের। চারু ও কারুকলার প্রতি হ্যাভেল সাহেবের ছিল ভীষণ আকর্ষণ। তিনি সর্বদাই চাইতেন আর্ট স্কুলের ছাত্ররা ভারতীয় রীতিতেই ছবি আঁকা শিখুক। অবনীন্দ্রনাথকে দেশীয় রীতিতে ছবি আঁকার ব্যাপারে হ্যাভেল সাহেব যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগান। হ্যাভেল সাহেবের মিউজিয়ামে মুঘল শিল্পের গোটা কয়েক নমুনা দেখে অবনীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে (১৯০৫) হ্যাভেল সাহেবের আগ্রহ ও অনুরোধে অবনীন্দ্রনাথ সরকারি কলাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। প্রায় এই সময়েই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধারাকে মিশিয়ে অবনীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন নিজস্ব এক নতুন ধারা। তখন থেকেই ভারতীয় শিল্প নবজন্ম লাভ করল। নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকল তাঁর অঙ্কন-শৈলী। সকলের কাছে তিনি পরিচিত হলেন-‘শিল্পী গুরু’ হিসেবে। তাঁর সান্নিধ্যে এলেন—নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার, শৈলেন্দ্রনাথ দে, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুরেন কর, মুকুল দে, বীরেশ্বর সেন, মনীন্দ্রনাথ গুপ্তের মতো ছাত্ররা। পরবর্তীকালে এই সব ছাত্ররাই ছড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে শিক্ষাগুরুর পদ গ্রহণ করে।
ছবি আঁকা বা লেখালেখি যাই হোক, মনে প্রাণে ভারতীয় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ভারতীয় শিল্প এবং প্রাচ্যশিল্প যাতে বিশ্বের দরবারে সমাদর পায়, তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন মানুষটি। ১৯০৭ সালে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ থাকাকালীনই দাদা গগনেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টসে’র। অবনীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আমরা করেছিলুম এমন একটা সোসাইটি। যেখানে দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সবাই একত্র হয়ে আর্টের উন্নতির জন্য ভাববে। শুধু ভারতীয় শিল্পই নয়, প্রাচ্যশিল্পের সব কিছু জিনিস দেখানো হবে লোকেদের।’
লর্ড কারমাইকেল, লর্ড রোনাল্ডসে, এডউইন মন্টেগু, মিস কার্প্লে, ভবানী চরণ লাহা প্রমুখের মতো শিল্পানুরাগীরা সোসাইটির আজীবন সদস্য ছিলেন। সে সময় সোসাইটি হয়ে উঠেছিল অবনীন্দ্রনাথের ধ্যান জ্ঞান।
১৯১৫ সালে আর্ট স্কুলের নতুন অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সঙ্গে মত বিরোধ ঘটায়, অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে সোসাইটির কাজে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। এ সময় জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দায় বসে সারাদিন মনের আনন্দে কেবল ছবি আঁকতেন। দেশ-বিদেশের বহু শিল্পরসিক এখানে আসতেন তাঁর আঁকা ছবি ও শিল্প সংগ্রহ দেখতে। বিভিন্ন প্রকার শিল্প সামগ্রী বহুদিন ধরে কিনে ঠাকুরবাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন বৃহদাকার শিল্প সংগ্রহ শালা। বলা বাহুল্য, জোড়াসাঁকোর বাড়িটি পরবর্তীকালে ভারতীয় শিল্পের এক অন্যতম পীঠস্থান রূপে পরিণত হয়েছিল।
সারা জীবনে অবনীন্দ্রনাথ অসংখ্য ছবি অঙ্কন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে—‘বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘বিরহী যক্ষ’, ‘ওমর খৈয়ম’, ‘গণেশ জননী’, ‘সমুদ্র কন্যা’, ‘ব্রজমুকুট’, ‘ঋতু সংহার’, ‘আরব্য রজনী’, ‘অভিসারিকা’, ‘নির্বাণ’, ‘যমুনা পুলিনে শ্রীরাধা’, ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’, ‘সাজাহান’, বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। তবে অবনীন্দ্রনাথ নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন ‘কৃষ্ণলীলা’ ছবি গুলিতে। তাঁর মন প্রাণ জুড়ে তখন বিরাজ করছিল কৃষ্ণ। আঁকতে আঁকতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। ইংরেজ গুরু পামার মুগ্ধ হয়েছিলেন ছবিগুলোর চরিত্র দেখে। অবনীন্দ্রনাথকে উৎসাহ দিলেন তিনি এ ধরনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ‘লাইফ স্টাডি’, ‘অ্যানাটমি’ ছেড়ে তখন থেকে অবনীন্দ্রনাথ সত্যিকারের রূপ ও ভাবের জগত গড়ে তোলায় মন দিলেন। এক সময় রবিকা (কাকা-রবীন্দ্রনাথ) তাঁকে ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ নিয়ে ছবি আঁকার কথা বলেন। অবনীন্দ্রনাথ তখন গোবিন্দ দাসের কবিতা অবলম্বনে দেশীয় পদ্ধতিতে আঁকেলেন—‘শুক্লাভিসার’। মুঘল আঙ্গিকে আঁকলেন—‘শাহাজাহানের মৃত্যু প্রতিক্ষা’,
‘শাহাজাহানের মৃত্যু প্রতিক্ষা’ ছবিটির জন্য কয়েকবার পুরস্কৃতও হন অবনীন্দ্রনাথ। নিজের বেদনা-মনোকষ্ট ছবিতে ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে বেদনা-মনোযন্ত্রণা একান্তই আর নিজের থাকেনি, হয়ে উঠেছিল সকলের। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইটিতে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এই ছবি এত ভালো হয়েছে কি সাধে? মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল, সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। … আমার বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে দিলুম।’
অবনীন্দ্রনাথের কন্যা উমা দেবী তাঁর ‘বাবার কথা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ছবিটির জন্য পদক-প্রাপ্তির সংবাদে তাঁর দিদিমার চোখ দিয়ে আনন্দ-অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। চোখের জলে তিনি পুত্রকে বলেছিলেন, ‘আমার সেই ছোট্ট ছেলে অব, কত কালিঝুলি-রং মেখে কাপড় নোংরা করত। কত বলেছি তার জন্যে। সেই রং আজ সোনা হয়ে আসবে কে জানত।’
পুত্র অলোকেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতেও পুরস্কৃত হন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের আর একটি বিখ্যাত ছবি—‘দাসখত’। অপূর্ব প্রেমের এই ছবিটি যে-কোনও দেশেই বিরল। একটি লতাবিতান, সরু দুটি থাম, নীল শ্যাম কুঞ্জ। রাধিকাকে শ্রীকষ্ণ বাম হস্তে বেষ্টন করে আছেন। রাধার চোখে মিথ্যে অভিমানের ছলনা। কৃষ্ণের চোখে কটাক্ষ দর্শনীয়। গালে লাল রঙের সামান্য আভা। পটভূমিতে নীল ও পীতাভ রঙের আশ্চর্য ব্যবহার। ছবিটি বার্লিংটন হাউসে ওরিয়েন্টাল আর্টের একটি প্রদর্শণীতে টাঙানো ছিল।
অবনীন্দ্রনাথ তাঁর আঁকা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ছবিগুলিতে স্বদেশ চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। গল্পের ভেতর দিয়ে শিল্পী তাঁর সময়ের স্বাভাবিক প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর ছবিগুলিতে। গল্পের বাগদাদ আর বাস্তবের কলকাতা এক হয়ে গিয়েছিল তাঁর আরব্য রজনীর ছবিগুলিতে। চারপাশের চরিত্রগুলো গল্প ও রূপকথার মোড়কে প্রকাশ পেয়ে ছিলো।
অবনীন্দ্রনাথের কাছে আঙ্গিকটাই সব ছিল না, ভাবটাই ছিল আসল। রঙের নিজস্ব নিবিড়তা ও বিশিষ্টতাকে ব্যবহার করে ভাবটাকে ফুটিয়ে তুলতেন তিনি। রঙে রঙে সংঘাত ও মিল ঘটিয়ে রূপকে প্রাণময় ও আলোকময় করে তুলথেন। অন্তরের বেজে ওঠা সুরকে ছবিতে অনুরনিত করেছেন প্রত্যেকবার।
স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়ে ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি। ছবিটিতে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর গভীর দেশপ্রেম ও অভিনব কল্পনার পরিচয় দিয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতা ছবিটি দেখে তৎকালীন ‘প্রবাসী’ (ভাদ্র, ১৩১৩) পত্রিকায় লিখেছিলন—’’ এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্রশিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করিবে বোধ হয়—চিত্র পটে তৎকর্ত্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি জিনিস; আকার —প্রকারও ভারতীয়।’’
ছবিটিতে দেবী চতুর্ভুজা। চার হাতে আছে—বেদ ধানের শীষ, জপের মালা এবং শ্বেত বস্ত্র। এগুলি মূলত ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক বহন করছে। যে গুলির মাধ্যমে অবনীন্দ্রনাথ সে যুগের (স্বদেশী আন্দোলনের যুগ) দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশীয়ানা এবং জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। প্রথম দিকে চিত্রটির নাম ছিল—‘বঙ্গমাতা’। পরে ভাগিনী নিবেদিতা এর নামকরণ করেন—‘ভারতমাতা’। চিত্রটির মধ্যে দিয়ে শান্ত, অভয় এবং সমৃদ্ধি প্রদানকারী মাতৃদেবীর রূপকে কল্পনা করা হয়েছে। চিত্রটি একাধারে মানবী ও দেবী হিসেবে কল্পিত হয়েছে। সমকালীন বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে মিছিলের সামনে চিত্রটি আন্দোলনকারীদের হাতে থাকত।
অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যদের ছবি এদেশে যেমন বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। তেমনি লন্ডন, প্যারিস ও টোকিওতে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁদের অনেক ছবি। ফলে তাঁর খ্যাতি কেবল ভারতে নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের বহু ছবি বিদেশি শিল্প রসিকেরা কিনে নেওয়ায় সেগুলি বিদেশে চলে গেছে। এছাড়া অবনীন্দ্রনাথ ছবি শেষ করে উপহার দিয়েছেন শিল্পরসিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও প্রিয়জনদের। অবনীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু ছবি রয়েছে—‘ভারতীয় মিউজিয়াম’, ‘ন্যাশনাল গ্যালারী (দিল্লী), কলাভবন (শান্তিনিকেতন), এবং দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে।
বলাবাহুল্য, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন। তিনি যে সব অতুলনীয় চিত্রকলা সৃষ্টি করেছিলেন তা শুধু সে যুগের নয়, আজও শিল্প রসিকদের মুগ্ধ করে। ভাবের অসাধারণ অভিব্যক্তিতে, কোমল রঙের ব্যবহারে, সূক্ষ্ম রেখার টানে তাঁর অঙ্কিত চিত্রগুলি চোখ ও মনকে অভিভূত করে। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় তিনি ছবি এঁকেছিলেন। ষাট বছরের কাছাকাছি এসে ছবি আঁকা প্রায় ছেড়ে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি নিজেই বলতেন—‘আর মন ভরে না।’ ছবি আঁকার পরিবর্তে মেতে উঠলেন কাঠের টুকরো, গাছের শিকড়, ভাঙ্গা ডাল পালা, নারকেলের মালা, আমড়ার আঁটির মতো তুচ্ছ উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে।
আবার শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ কেবল ছবি আঁকায় বা কুটুম-কাটাম নির্মাণে মগ্ন থাকেননি, শিল্পতত্ত্ব নিয়ে তাঁর সুগভীর অধ্যায়ন, মৌলিক ভাবনা আমাদের মনে আজও বিস্ময় জাগায়। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পতত্ত্ব বিষয়ক যে বক্ততামালা তিনি দিয়েছিলেন, তা শিল্পচর্চার ইতিহাসে পরম সম্পদ। সেই বক্তৃতামালারই গ্রন্থিত রূপ ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’।
একসময় অবনীন্দ্রনাথ হঠাৎই হাতে তুলে নেন কলম। ‘রবিকা’-ই (রবীন্দ্রনাথ) তাঁকে এনেছিলেন শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে। রবীন্দ্রনাথ আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ যেভাবে বাড়ির ছোটদের গল্প বলেন, অবন যেন সেভাবেই লেখে। রবিকা’র এই প্রত্যাশা অবনীন্দ্রনাথ পূর্ণ করেছিলেন যথার্থভাবেই। কালিদাসের নাটক থেকে নির্যাস নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন, ‘শকুন্তলা’। সেই শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকাননি। শিশুসাহত্যে পেলেন অভাবনীয় সাফল্য। অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কয়েকটি শিশু সাহিত্য—‘ক্ষীরের পুতুল’ (১৮৯৫), ‘রাজ কাহিনী’ (১৯০৯), ‘ভূত পতরীর দেশ’ (১৯১৫), ‘বাংলার ব্রতকথা (১৯১৯)’, ‘খাজাঞ্চির খাতা’ (১৯২১), ‘প্রিয়দর্শিকা (১৯২১), ‘চিত্রাক্ষর’ (১৯২৯), ‘বসন্তের হিমালয়’, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ (১৯৪৪), ‘মাসি’ (১৯৫৪), ‘রংবেরং’ (১৯৫৮), ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী (১৯২৯)… প্রভৃতি কালজয়ী সাহিত্য।
লেখার প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলীর কথা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধে অবনীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে ‘রানী বাগেশ্বরী অধ্যাপক’ হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। ১৯২১ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত তিনি ঐ পদে থেকে মোট ২৯টি বক্তৃতা দেন। যেগুলি পরে ‘বাগেশ্বরী প্রবন্ধাবলী’ নামে পরিচিতি পায়। অবনীন্দ্রনাথের দেওয়া বক্তৃতাগুলি তৎকালীন ‘বঙ্গবানী’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘বাগেশ্বরী প্রবন্ধাবলী’ সম্পর্কে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু বলেছিলেন—
‘‘শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী বক্তৃতামালা রূপকলার আলোচনার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী গ্রন্থ এবং এ যুগে আমাদের মধ্যে রসবোধের উন্মেষ সাধনে অতুলনীয় এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বঙ্গ সাহিত্যে এটি একটি অমূল্য সম্পদ।’’
পাণ্ডিত্যে ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে ১৯২১ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডি. লিট.’ দিয়ে সম্মানিত করেন।
৬০ বছরের কাছাকাছি এসে ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। নিজেই বলতেন ‘আর মন ভরে না’। তার পরিবর্তে কাঠের টুকড়ো, গাছের শিকড়, ভাঙ্গা ডালপালা, নারকেলের মালা, আমড়ার ‘আঁটির মতো তুচ্ছ উপকরণ দিয়ে তৈরি করতেন নানা সামগ্রী।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট সবকিছু কেমন যেন বদলে গিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের। সেদিন তাঁর ৭১ তম জন্মদিন। অথচ বদলে গিয়েছিল জন্মদিনের তাৎপর্যটাই। এমন বিয়োগান্ত জন্মদিন আগে কখনো আসেনি তাঁর। কিছুক্ষণ আগেই রবিকাকা পাড়ি দিয়েছেন চিরঘুমের দেশে। অবনীন্দ্রনাথ সে সময়ে দক্ষিণের বারন্দায় বসে আপন মনে এঁকে চলেছেন রবিকাকার অন্তিম যাত্রার ছবি। ছবিটি পরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
১৯৪১ সালে অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে বরাহনগরের ‘গুপ্ত নিবাসে’ ওঠেন। জীবনের অন্তিম কটা দিন কেটেছিল সেখানেই। ১৯৫১ সালের ৫ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান ‘শিল্পগুরু’ অবনীন্দ্রনাথ।