ওই এক টুকরাে কাপড়ের কত অমর্যাদা, কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। রাস্তায় বের হলে দেখা যায় প্রতি দশজনের মধ্যে ছয়জনই মাস্কহীন। আবার যে চারজন পরে আছেন, তাঁদের মধ্যে দুজনেরই তা থুতনিতে নামানাে। অর্থাৎ মাস্ক না পরার সামিল।
যত দিন যাচ্ছে, করােনা নামক করাল ভাইরাসটি জাঁকিয়ে বসছে, সেই সঙ্গে মাস্ক পরে রাস্তায় বের হওয়া, বাজারহাট করা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। না পরলে দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন তাে প্রণয়ন করে সরকার, কিন্তু তাকে মান্যতা দিয়ে চলা মানুষের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
পুলিশ প্রথম দিকে মাস্কহীনদের ধরে বাড়িতে পাঠিয়ে দিত অথবা ফাইন করত। লকডাউনের সময় পুলিশবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে- কান ধরে ওঠবােস করিয়েছে কিন্তু এখন অনেকটা ঢিলেঢালা ব্যবস্থা, মাস্ক না পরা কেউ পুলিশের কাছ দিয়ে চললেও পুলিশ কোনাে ব্যবস্থা নেয় না। নিষ্ক্রিয়।
কিন্তু এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রােধ করতে প্রধান প্রতিরােধ কিন্তু এই এক টুকরাে কাপড়ই। চিকিৎসকদের মতে, বিজ্ঞানীদের মতে, গবেষকদের মতে ওই মাদক নিয়মিত ঠিকঠাক মতাে পরাই সংক্রমণকে দূরে ঠেলে রাখতে পারে। তার সঙ্গে অবশ্যই যােগ করতে হবে দূরত্ব বিধি রক্ষা করে চলা। মাস্কহীন পশ্চিমবঙ্গ এখনও যদিও হয়নি কিন্তু দূরত্ব বিধি, যাকে বলা হয় ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং, অবলীলায় লঙিঘত হচ্ছে।
প্রথমে বলা হল, সরকারি এবং বেসরকারি বাসে, যত আসন তত যাত্রী থাকবে, কেউ দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না। বােধহয় একদিনের জন্যও ওই নিয়ম মানা হয়নি। এখন প্রতিটি বাসে গাদাগাদি করে, একজনের ঘাড়ের ওপর আরেকজন পড়ে যাতায়াত করছে।
হাটেবাজারে, শপিং মলে, বিগবাজারে, হকার্স মার্কেটে, নিউ মার্কেটে— পুজোয় কাপড়চোপড় এবং বিভিন্ন সামগ্রী কেনার জন্য এখন প্রচণ্ড ভিড় হচ্ছে, দূরত্ব বিধি রক্ষা করা হচ্ছে না। এই বিধি রক্ষা করে চলা প্রায় সম্পূর্ণটাই মানুষের সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। মানুষ যদি নিজেদের ভালাে-মন্দ, সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার উপায় নিজেরা না খোঁজেন তাহলে এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সামান্যই।
দৈনিক স্টেটসম্যান আশা করে শাসক দল সহ অন্যান্য বিরােধী দলগুলি এই কঠিন পরিস্থিতিতে একটু সংযমের পরিচয় দিক। যেভাবে মিছিল নিয়ে সব দল রাস্তায় নামছে, দূরত্ব বিধি ভাঙছে, তা কিন্তু সংক্রমণের বড় সহায়ক হচ্ছে।
ভােট আসতে এখনও ছয়-সাত মাস বাকি, সে পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে, অতি সতর্কতার সঙ্গে রাজ্যের নেতারা চলুক। ভুলে যাবেন না, আপনারা নানা ইস্যুতে মিছিল বের করে পথ পরিক্রমা করছেন, আর মিছিল যে রাস্তায় যাচ্ছে, তার পাশেই কোনাে কোভিড হাসপাতালে কত করােনায় আক্রান্ত বাঁচার জন্য সংগ্রাম চালাচ্ছেন। যাদের রাজনীতিতে মন, তাদের এটা নেশার মতাে- কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভােটের চিন্তা থেকে একটু বিরত থাকুন।
তারা কেন ভাবছেন না, গত দুমাস হল প্রতি ২৪ ঘণ্টায় করােনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে। এভাবে সংক্রমণ বাড়লে রাজ্য একটি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, আসন্ন পুজোয় দর্শনার্থীদের যে ঢল শহরের রাস্তায় নামবে, তাতে সংক্রমণ বাড়বে ছাড়া কমবে না। কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, কত পরিবার এখন শােকস্তব্ধ, আপনজনদের হারিয়ে, কাজ হারিয়ে কত মানুষ নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় বসে, তাদের সময় নেই ভাববার যে পুজো আসছে।
প্রতিদিনের কঠোর সংগ্রামের মধ্যে তাদের চলতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন জোগাতে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সমর্থকেরা তাদের কথা একটু ভাবুন, ভােটের চিন্তা সাময়িক ভুলে গিয়ে। এরই মধ্যে কিছু রাজনৈতিক নেতা, সাংসদ রব তুলেছেন অবিলম্বে শহরতলির ট্রেন চালু করতে।
তারা কি ভেবে দেখেছেন শুধু পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশন হয়ে প্রতিদিন ১৫ লক্ষ যাত্রী শহরে ঢােকেন? তারা যেভাবে বাদুড়ঝােলা হয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে যাতায়াত করেন, তা শুধু ভুক্তভােগীরাই জানেন। এই বিপুল সংখ্যক যাত্রীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন রেলের কর্তারা? মেট্রো রেল চালু আর লােকাল ট্রেন চালু, এক কথা নয়। তারপর সংক্রমণ যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে, তখন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা চোখে অন্ধকার দেখনে।