প্রবীর মজুমদার
৯ আগস্টের সেই নৃশংস মর্মান্তিক ঘটনার কথা সারা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে মীনাক্ষী-দেবাঞ্জন সহ বাম ছাত্র-যুবরা ডাক্তার ছাত্রীর শববাহী গাড়ি আটকে প্রশাসনের সঙ্গে প্রথম নৈতিক যুদ্ধ না করলে আজ প্রায় এক মাস ধরে রাজ্যে আলোড়ন ফেলে দেওয়া ঘটনাটা সাধারণ মানুষ ঘুণাক্ষরে জানতেও পারতেন না হয়তো। আরজিকর-এর ন্যাক্কারজনক ঘটনার রেশ যেন রাজ্য ছেড়ে দেশ থেকে বিদেশে সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করেছে, আর সেই আলোড়নের ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিদিন কলেজ স্কোয়ার থেকে যেমন বিভিন্ন প্রতিবাদ-মিছিল একের পর এক সংগঠিত হচ্ছে, তেমনই সারা রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও মিছিল হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।
আমরা কখনও ভাবিনি আমাদের চাপা ক্ষোভই একদিন আমাদের পথে নামাবে, সারারাত, সারাদিন। আট থেকে আশি সকলকে নিয়ে। না, কেবল মহিলার সুরক্ষার কথা বলব না। রাজনৈতিক জাঁতাকলে আর ধারাবাহিকভাবে দেখতে থাকা সামাজিক অবক্ষয়ে, পুরুষ-নারী কেউই আজ সুরক্ষিত নয়। গত বছর যাদবপুরে স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুকাণ্ডে দেখেছি, কীভাবে একটি জ্বলজ্যান্ত ছেলেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়, এ বছর ঠিক ওই একই দিনে দেখলাম চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। হয়তো দুটি ঘটনাই ভীষণভাবে সুপরিকল্পিত, হয়তো দুটি ঘটনার পিছনেই বিরাট দল ও বড় বড় মাথারা কাজ করছে- কিন্তু এই দুটি ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল কোথায় জানেন? দুটোই দেখিয়ে দিল দু-বছর পর পর যে- ১) পুরুষনারী-নির্বিশেষে গোটা সমাজ কতটা অসুরক্ষিত, ২) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই গুরুত্বপুর্ণ দুই পিলারের পরিকাঠামো আজ কতটা নড়বড়ে। ঠিক সে কারণেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে এলে আমরা আর কেউ আশ্চর্য হই না। একটা ধর্ষণ-হত্যা আজ আমাদের জানিয়ে দিল সরকারি হাসপাতাল ঠিক কতখানি দুর্নীতির আঁতুরঘর হয়ে উঠেছিল। জানিয়ে দিল, সাধারণ মানুষের মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসার জাল ঠিক কতদূর সুবিস্তৃত হয়েছে, জানিয়ে দিল দোষ ঢাকতে ঠিক কী কী উপায়ে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে হয়, সর্বশেষ এও জানাল যে মৃত ব্যক্তি যদি মহিলা হয় তাহলে সবার আগে তাকেই দোষারোপ করা বর্তায়।
প্রায় এক মাস ধরে ঘটে চলা বিভিন্ন মিছিল দেখে বারবার মনে হচ্ছে, এ যেন একটি বড় ইস্যুকে বিভিন্ন ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেখা এবং নানাবিধ গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কখনো হচ্ছে বাচিক শিল্পীদের মিছিল, কখনো হচ্ছে মেকআপ আর্টিস্টদের মিছিল, কখনো আইনজীবীদের মিছিল, কখনো অভিনেতাদের মিছিল, আবার কখনো ডগ লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের মিছিল। প্রত্যেকটি স্কুল, কলেজ আলাদা আলাদা করে মিছিল বার করছে। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। একথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না, যে জনগণ যত ভাগ ভাগ হয়ে আন্দোলন করবে সরকারের ভয় তত কমবে।
সবথেকে খেয়াল করার মত বিষয় হল, মিছিলের দাবিগুলো কিন্তু আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অনেক মহিলাকে দেখলাম জীবনে প্রথমবার বিচারের দাবিতে পথে নামতে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু দেখলাম, তাঁদের হয়ে স্লোগান বা দাবি অন্য কেউ ঠিক করে দিয়েছে। আলাদা আলাদা স্কুলের প্রাক্তনীদের আলাদা করে মিছিল করা এই আন্দোলনের দস্তুর। তেমন এক স্কুল প্রাক্তনীদের মিছিলের ব্যানারে লেখা দেখা গেল ‘সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা’। একই ব্যানারে লেখা ছিল ‘গুঁড়িয়ে দেব পিতৃতন্ত্র কেঁপে উঠবে রাষ্ট্রতন্ত্র’। এই দুটি লেখার মাঝখানে বড় করে লেখা ‘তিলোত্তমার বিচার চাই’। এমন ব্যানার নিয়ে হাঁটছেন বিভিন্ন বয়সী মহিলারা। তাঁরা নিজেরা বিচার বলতে কী বুঝছেন তা খুব স্পষ্ট নয়। আবার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য জানান, তিনি মনে করেন আর জি কর নিয়ে আন্দোলন করলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তাঁর সংগঠন যে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে সেখানে এসব কথা বলা যাবে না। সেখানে শুধু ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ বলতে হবে। অর্থাৎ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বলে যাকে দাবি করা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু মোটেই সর্বদা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না মানুষকে। আন্দোলনের নেতৃত্ব যথারীতি আন্দোলন থেকে কোন দাবি করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না তা বেঁধে দিচ্ছেন।
এ কথা স্পষ্ট, যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন রেগে আছেন। তাঁদের রাগ বিভিন্ন কারণে। শুধুমাত্র একটি সরকারি হাসপাতালে একটি ধর্ষণ ও খুনের কারণে তাঁরা রাস্তায় নামছেন – এরকম ভাবা বোধহয় ঠিক নয়। বিভিন্ন কারণে তাঁদের যে চাপা রাগ ছিল সরকারের প্রতি, এত মিছিলে এত মানুষের যোগ দেওয়া তার বহিঃপ্রকাশও বটে। এত মানুষের সম্মিলিত রাগকে বিক্ষিপ্ত করার কাজও এই অজস্র মিছিল করে চলেছে। অনেক মানুষ, যাঁরা হয়ত আগে মনে করতেন সামাজিক মাধ্যামে দু লাইন লিখলেই প্রতিবাদ জানানো হয়, তাঁরা একঘন্টার জন্য হলেও পথে নেমেছেন। এই পথে নামাকে সম্মান করেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এত ছোট ছোট গোষ্ঠীর মিছিল আসলে সরকারের হাতই শক্ত করছে। শহর কলকাতা, শহরতলির বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসছে, তৃণমূলের নেতারাই এই ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ ব্যানার হাতে মিছিল বার করছে। তারা ‘জাস্টিস’ বলতে ধর্ষকের ফাঁসি দেওয়া ছাড়া আর কিছু চাইছে কিনা তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আর জি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভয়াবহতা বহুমাত্রিক। সেই ভয়াবহতা চাপা দিতে এই অজস্র মিছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সহায়তা করছে এবং সাধারণ মানুষের চোখে পুরো বিষয়টাকে গুলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এই মিছিলগুলোতে স্পষ্ট।
নারীবাদীদের কাছে পিতৃতন্ত্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক শুনতে ভালই লেগেছে। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন মিছিলে দেখছি ভীষণরকম নারীবিরোধী কথা বার্তা হচ্ছে। স্কুলপড়ুয়া বাচ্চা ছেলেদের মুখে পুলিশের উদ্দেশে বলা ‘তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়…’ স্লোগান যে ভয়ংকর পিতৃতান্ত্রিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া, তা বোঝার ক্ষমতা রাজ্যবাসীর চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই স্লোগানকে তাঁদের বৈপ্লবিক মনে হচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ এই ধরনের আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু এই আন্দোলনের অভিমুখকে বিপন্ন করছে।
এই আন্দোলনের আরও একটি প্রবণতা দেখা গেছে। যেন আর জি করের ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে কেবল নারী নির্যাতন নিয়েই আলাদা করে বলতে হবে, দুর্নীতি নিয়ে বলা যাবে না। কাজেই কোনো কোনো মিছিলকে শুধু লিঙ্গসাম্যের জন্যে মিছিল বলা হচ্ছে। সেখানে স্বাস্থ্য দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে একটিও কথা বলা যাবে না – এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট, যে দুর্নীতির কারণেই আর জি করের তরুণী ডাক্তারকে খুন এবং ধর্ষণ করা হয়েছে। ঘটনার কারণটাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ঘটনাটাকে প্রাধান্য দেওয়া একেবারেই চিন্তার দৈন্যতার প্রবণতা।
আরও একটা কাজ এই বহুধাবিভক্ত আন্দোলন করেছে। আমাদের ভাবিয়েছে যে শুধু প্রতিবাদ করলে হবে না। প্রতিবাদকে সোশাল মিডিয়ায় দৃশ্যমান করতে হবে। কোথাও যেন এই ব্যাপারটা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে সব মানুষকে তিলোত্তমার জন্য মিছিলে হাঁটতেই হবে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকে এবারে কতটা সামাজিক মাধ্যম পরিচালিত করল তা নিয়ে একটা আলাদা গবেষণাপত্র লিখে ফেলা যায়। অথচ দৃশ্যমান প্রতিবাদের আড়ালে থেকেও ন্যায়ের জন্য বহু মানুষ নানাভাবে কাজ করে চলেছেন। একথা ভুলে গেলে চলবে না, যে আমাদের দেশে যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইন তৈরি হয়েছে, তার ভিত্তি ‘বিশাখা গাইডলাইন’। রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলা ভাঁওরি দেবীর উপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণের কারণেই আমাদের দেশের মেয়েরা এই আইন পেয়েছে। সেই ধর্ষণের ঘটনাও কিন্তু একটা মাত্র কারণে ঘটেনি। ‘বিশাখা গাইডলাইন’ একটি নিছক লিখিত নিয়মাবলি হলেও এটি একটি কর্মরত মহিলার অস্ত্র। আজও বহু জায়গায় কর্মক্ষেত্রে মহিলারা যৌন হয়রানির শিকার হলেও কাজ যাওয়ার ভয়ে, সমাজের ভয়ে বা লোকলজ্জার ভয়ে সে কথা বলেন না। লিঙ্গ হিংসার পিছনে নানারকম কারণ থাকে। আর জি করের ঘটনার পিছনে মূল কারণ দুর্নীতি। রাষ্ট্র সবসময় চাইবে বড় সমস্যাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দিতে। ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ আন্দোলনকে সেই পথেই চালনা করার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে বৃহত্তর কারণগুলোর দিকে এই আন্দোলন ধাবিত না হয়। এভাবে চললে সমস্যার সমাধান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে যাব বলে মনে হয়।
সব শেষে এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে দুই একটা কথা বলা জরুরি। প্রথম সীমাবদ্ধতাটা ইস্যুটির মধ্যেই আছে। আন্দোলনের মূল দাবিটি যেহেতু খুনির সন্ধান ও তার কঠোর শাস্তি এবং আদালতের নির্দেশের পর শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত হয়েছে, তাই এই আন্দোলনকে যদি নতুন স্তরে উন্নীত না করা যায়, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। দ্বিতীয় বিষয়টি হল আন্দোলনের মূল শক্তি এখনও পর্যন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত, এলাকা বিচারে শহরাঞ্চল, যা ভাঙতে পারার উপরেই আন্দোলনের পরবর্তী সাফল্য নির্ভর করছে।