নেতাজির কাছে এক ভিখারিণীর প্রদেয় ‘তিন টাকা’ দানই ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর কাছে শ্রেষ্ঠ দান

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (File Photo: IANS)

 

সালটা ছিল ১৯৪২। মালয়ে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের কথা ভেবেছিলেন মোহন সিং। গঠন করলেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ। সেই সময় জাপানে ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। তিনি হলেন ওই বাহিনীর সর্ব্বের সর্ব্বা। ওই সময় সুভাষচন্দ্র এলেন জাপানে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে হলো আলোচনা। এই আলোচনার পর জাপ প্রধানমন্ত্রী ১৯৪৩ সালের ১৬ জুন ঘোষণা করলেন অ্যাংলো  সাক্সনরা হলো ভারতের শত্রু। তাদের বিতাড়িত করতে জাপানিরা সর্বতোভাবে ভারতীয়দের সাহায্য করবে। সুভাষচন্দ্র চাইছিলেন জাপানিরা এটা ঘোষণা করুক। জাপান কর্তৃক ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিশ্রুতি দেবার পরই তিনি ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করে যুদ্ধ করতে সম্মত হন। গঠিত হল আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তারিখটা ছিল ২১ অক্টোবর ১৯৪৩। ওই দিন গঠিত হলো আজাদ হিন্দ সরকার। নেতাজি ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ২৩ অক্টোবর যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লিপ্ত হওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন সভায় ভাষণ দিতে লাগলেন। তেমনই একটি সভা হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ৯ জুলাই। সেদিন আকাশে ছিল কালো মেঘের ঘনঘটা। নামল বৃষ্টি। নেতাজির ভাষণ শুনতে সেদিন জনসভা ছিল পরিপূর্ণ, এককথায় সেদিন জনতার ঢল নেমেছিল। সেদিন অত বৃষ্টির মধ্যেও কেউ জনসভা ছাড়েননি। সবাই বৃষ্টিতে ভুজেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেতাজির ভাষণ শুনছিলেন। সেদিন নেতাজি ওই প্রবল বর্ষণের মধ্যেও প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর’ ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঘোষণা করে দিলেন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক সুভাষচন্দ্রর আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের প্রথম দিনের বক্তব্য হতে সেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মকুশলতা, আত্মনির্ভর সাহসিকতার যে পরিচয় আমরা পেয়েছি, তা অবর্ণণীয়। বর্মায় সুভাষচন্দ্র কী কৌশলে হিন্দু-মুসলমান-শিখকে এক করতে পেরেছিলেন, তা অবাক করেছিল সৈয়দ মুজতবা আলির মতো ব্যক্তিত্বকে।


মুজতবা আলি রেডিওতে সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, রাজনৈতিক অন্তদৃষ্টি ও দেশকে মনপ্রাণ, সর্বচৈতন্য ও সর্বানুভূতি দিয়ে ভালবাসা এবং সাম্প্রদায়িক কলহের উর্ধ্বে নির্দ্বন্দ্ব পুণ্যলোকে বিরাজ করে যে মহাপুরুষ দেশের অখণ্ডকে সত্যরূপ ঋষির মতো দর্শন করেন, তারই পক্ষে এই ঐক্যের আহ্বান জানানো সম্ভব, এই আহ্বানের ভাষা মহাত্মাগণের আদর্শ ভাষা। সৈয়দ আলি অনুভব করেছিলেন, সুভাষচন্দ্র বলেই সব বাধাবিঘ্ন ত্যাগকরে সর্বদ্বন্দ্বের উর্ধ্বে উঠে সাধারণ সৈন্যকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তার উজ্জ্বল আদর্শই ছিল সর্বজনগ্রহণীয় এক মহান আদর্শ। যার মূল আদর্শই ছিল, হিন্দু-মুসলমান-শিখ নয়, দেশের স্বাধীনতা যজ্ঞে আত্মাহুতি দেওয়াটাই মূল মন্ত্র।

আজাদহিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েও তিনি যে কত কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন, তার একটি ঘটনার কথা বলি।

১৯৪৩ সালের ৯ জুলাই নেতাজি বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নামছেন। এমন সময় তিনি দেখলেন, এক বৃদ্ধা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। সেই বৃদ্ধা নেতাজির সামনে এসে অবাক হয়ে নেতাজিকে দেখছিলেন, তারপরেই ঘটল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। হঠাৎই সেই বৃদ্ধা নীচু হয়ে নেতাজির পায়ে হাত দিতে যাচ্ছিলেন। নেতাজি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তাই সেই বৃদ্ধা নেতাজির পায়ে হাত দেবার আগেই, সেই বৃদ্ধাকে তিনি তুলে ধরলেন। বৃদ্ধা অবাক!

সেদিন সেই বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে নেতাজির উক্তি ছিল, ‘আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি কেন আমার পায়ে হাত দেবেন?’ সেই মুহূর্তে বৃদ্ধা কিছু বলার আগেই তিনি বৃদ্ধার দু’টি হাত নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, ‘মা, আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন। সবাই বিস্ময়ে সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করল। সেই মুহূর্তে নেতাজির চোখ জলে ভরে উঠল। এ এক নেতাজির মতো ব্যক্তিত্বের কোমল হৃদয়ের মাতৃঅঞ্জলি।

এবার বলব, এক গরিব অসহায় বৃদ্ধা মহিলার আজাদ হিন্দ বাহিনীকে প্রদেয় শ্রেষ্ঠ দানের কথা।

নেতাজি যখন নানা স্থানে দেশের জন্য সকলের কাছে সাহায্যের আবেদন করছেন, জনসভা করছেন, ঠিক তেমনই এক জনসভা, সেটিও ছিল সিঙ্গাপুরে, সেদিনের সেই জনসভা ছিল ‘আজাদ হিন্দ বহিনীকে’ সাহায্যের জন বিশাল জনসভা।

এক বৃদ্ধা ভিখারিণী সেদিন কিছুই ভিক্ষা পাননি। সে ওই জনসভা দেখে ভাবলো, ওইখানে বুঝি কিছু খাবার ভিক্ষা পাওয়া যাবে। এই ভেবে সে জনসভায় এলো। কিন্তু ভিক্ষা কোথায়? সবাই যেতে চায় জনসভার মঞ্চে। ওই ভিখারিণী কোনওদিনও আগে নেতাজিকে দেখেননি। শুধুমাত্র নাম শুনেছেন। সেই মঞ্চের দিকে সকলের এগিয়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল, ওই মঞ্চে নেতাজি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ সরকারকে মুক্ত হস্তে দান করার আবেদন করায় সকলে যে যার কাছে যা কিছু সম্বল আছে, তা দান করতে যাচ্ছে।

সেই মুহূর্তে ওই হতদরিদ্র বৃদ্ধা এগিয়ে চলল মঞ্চের দিকে। নেতাজির কাছে ওই জীর্ণ কাপড় পরিহিতা ভিখারিণীকে সকলে বলতে লাগল, তুমি তো ভিখারিণী, তুমি নেতাজিকে কী দেবে?

ওই ভিখারিণী বললেন, নেতাজি তো বলেছেন যার যা কিছু আছে, সবকিছু দিয়ে দিতে।

লোকজন বলল, তো তোমার আছেটা কী, যে তুমি দেবে?  তুমি তো ভিখারিণী।

বৃদ্ধা কারও কথা না শুনে, এগিয়ে চলল নেতাজির দিকে। নেতাজির পাশে ছিলেন শাহনওয়াজ খান। তিনি নেতাজিকে বললেন, ওই বৃদ্ধা তো আপনার দিকেই এগিয়ে আসছেন।

নেতাজি বললেন, ওনাকে আসতে দাও.

বৃদ্ধা নেতাজির কাছে এলেন এবং বললেন, তুমি বলেছ যার যা আছে তাই দিতে। কিন্তু আমার কাছে আছে তিনটি টাকা, এটি তোমায় আমি দিতে এসেছি, এটি নাও।

অবাক নেতাজি! তিনি বললেন, না, মা না, তোমার ওই টাকা আমি নিতে পারব না। নেতাজির ওই কথায় বৃদ্ধা কান্নায় মুষড়ে পড়লেন, ভেঙে পড়লেন। বৃদ্ধা বললেন, এর বেশি যে আমার কিছু নেই, এটি তো আমার যথাসর্বস্ব।

নেতাজি বললেন, মা, তুমি কত মানুষের কত লাঞ্ছনা, কত গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে ভিক্ষা করে ওই টাকা করেছ। আ কী করে এ টাকা নিই বলো?

সেই ভিখারিণী বৃদ্ধা বললেন, সব্বাই কত কিছু দিচ্ছে। আমি তো দিচ্ছি মাত্র তিনটি টাকা, এটা তুমি গ্রহণ করো নেতাজি।

নেতাজির চোখে জল। তিনি হাত বাড়িয়ে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন বৃদ্ধার টাকা। বৃদ্ধা নেতাজির হাতে তিনটি টাকা দিয়ে আনন্দে চলে গেলেন। নেতাজি অপলক দৃষ্টিতে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পরে শাহনওয়াজকে নেতাজি বললেন, তুমি লিখে রেখ, আজাদ হিন্দ ফৌজকে প্রদেয় যত দানের টাকা আমরা পেয়েছি, সেই সব দানের মধ্যে ওই ভিখারিণী বৃদ্ধার প্রদেয় দানের ‘তিন টাকাই’ হল আমার ‘শ্রেষ্ঠ দান’। প্রণাম ওই ভিখারিণী মহিলাকে।