ইস্তাহারে আছে, প্রচারে নেই
ত্রিদিবরঞ্জন ভট্টাচার্য
জলবায়ুর পরিবর্তন— প্রকৃতির অগ্নিবলয়ে দাঁড়িয়ে আমরা কি উপলব্ধি করছি? পুড়ছে গোটা দেশ৷ আর তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ডে দগ্ধ রাজ্যবাসী৷ আর শুধু আমরা নই, সারা দুনিয়াই উষ্ণায়নের গ্রাসে৷ তবুও আমরা প্রায় নির্লিপ্ত৷ কিন্ত্ত এই নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা কিংবা স্বার্থের সংঘাতে আমরা প্রতিদিন এগিয়ে চলেছি খাদের শেষ কিনারে৷ গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘পরিবর্তিত জলবায়ুতে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা শুধু উদ্বেগের নয়, কলকারখানা, মাঠেঘাটে যাঁরা কর্মরত রয়েছেন তাঁদের কাছে শুধু জীবিকার নয়, জীবনের পক্ষে অশনি সংকেত৷
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই বিশ্বের সব প্রান্তেই শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷ বিশ্বের ৭০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ জলবায়ুর পরিবর্তনে ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে৷ আর প্রতিবছর কয়েক হাজার কর্মীর মৃতু্যর কারণ হয়ে উঠছে উষ্ণ জলবায়ু৷
চিরাচরিতভাবে মন্দার আঘাত বেশি আসে গরিবদের ওপরেই৷ জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিশ্বের আর্থিকভাবে দুর্বলদের জীবন-জীবিকার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়৷ তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, হ্যারিকেন তো তাঁদের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী৷
২০২০-এর পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব শ্রম সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ৩.৪ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন =১০০ কোটি) শ্রমশক্তির ২.৪ বিলিয়ন কর্মীর কাজের কোনও সময়ে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছে৷ বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ২০০০ সাল থেকে কর্মীর এই অনুপাতটি ৬৫.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭০.৯ শতাংশ৷
বিশ্বজুড়েই শ্রমিকরা জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনে সব শ্রেণির কর্মী ঝুঁকির মুখোমুখি হলেও পুরুষ, মহিলা, কমবয়সী, বয়স্কদের ক্ষেত্রে কাজের ভূমিকার বিভিন্নতায় ও ঝঁুকি, বিপদের কমবেশি হেরফের হয়ে থাকে৷ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিতে এবং দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজের জন্য মহিলারা অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকির মুখে৷ গর্ভাবস্থা জটিলতার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব ইত্যাদি৷ অন্যদিকে পুরুষরা ভারী কায়িকশ্রম করায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাঁরা সবসময় বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন৷ তরুণ শ্রমিকরা প্রায়ই কৃষি, নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো কাজে অত্যধিক তাপের মধ্যে কাজ করে৷ আর এজন্য দুর্ঘটনার শঙ্কা প্রতিনিয়ত৷ আর পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি৷ সাধারণভাবে যেখানে ঝুঁকি বেশি, দৈহিক পরিশ্রম বেশি তাদের কর্মক্ষেত্রে৷ ভাষাগত কারণেও পরিযায়ী শ্রমিকরা পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি (OSH) বুঝতে না পারায় জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় আরও বেশি৷
আর অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝঁুকি সবচেয়ে বেশি৷ আর্থিক উদ্বেগের কারণে স্বাস্থ্য, অসুস্থতা— সব কিছু অগ্রাহ্য করেও তাঁরা কাজ করে যেতে বাধ্য হয়৷
প্রায় ২৪১ কোটি শ্রমিক অতিরিক্ত তাপের শিকার৷ এদের মধ্যে ২২.৮৫ মিলিয়ন তাপের কারণে বিভিন্ন পেশাগত সমস্যার মুখোমুখি হন৷ আর তাপ সইতে না পেরে বছরে প্রায় ১৯ হাজার শ্রমিকের মৃতু্য হয়৷ এছাড়া সৌর অতিবেগুনি (ইউ ভি র্যাডিয়েশন) প্রায় ১৫০ কোটি কর্মী ত্বকের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের শিকার (এদের অধিকাংশই নির্মাণ, কৃষি, বিদু্যৎ, ডাক, ডক কর্মী)৷
এছাড়াও ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন পতঙ্গবাহিত রোগ, কর্মস্থলের পরিবেশ, জলবায়ুর অস্বাভাবিকতার কারণে কৃষক, নির্মাণ পেশার শ্রমিকদের ঝুঁকি বাড়ছে৷
সংক্ষেপে বলা যায় যে, জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বের ৭০ শতাংশ শ্রমিকের গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির ‘ককটেল’ তৈরি করছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত পরিণতির মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন অসুখ, কিডনির কর্মহীনতা এবং মানসিক অসুস্থতা৷
জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে উষ্ণায়নের ফলে শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি ছাড়া তাঁরা অন্যভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দুর্দশায় পড়ছেন৷ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে খরা, জলকষ্ট বাড়ছে৷ ফলে শ্রমিকরা পরিস্রুত জল, স্যানিটেশনের সুস্থ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাঁদের বিভিন্ন রোগের জন্য সংবেদনশীল করে তুলছে৷ এছাড়াও কর্মসংস্থানের ওপর জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবগুলির মধ্যে চাকরি হ্রাস, ব্যবসায়িক সংসদের ক্ষতি এবং ব্যবসায়িক বাধা, শ্রম উৎপাদনশীলতা এবং জোরপূর্বক অভিবাসন অন্তর্ভূক্ত থাকতে পারে বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে৷
বিশ্ব শ্রমিক সংস্থার এই রিপোর্ট প্রকাশিত হবার আগে এই বছরের শুরুতেই ‘গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি’ পত্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে কতটা প্রভাব ফেলতে চলেছে তা তুলে ধরেছে তাদের একটি প্রতিবেদনে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে শ্রম-উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে৷ আর এই হ্রাস সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ এই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা এবং আমেরিকার (উত্তর/দক্ষিণ) বিভিন্ন অঞ্চলে শারীরিক কাজের ক্ষমতা ৭০ শতাংশে নেমে আসবে৷
বিশ্ব শ্রমিক সংস্থার রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে আগামীদিন তাপমাত্রা কীভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে তার আভাস দিয়ে আমরা যাব অন্য প্রসঙ্গে৷ ২০২৩ সালে পৃথিবীর পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা উষ্ণতম ছিল (জুলাই)৷ ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৯ শতকের গড় তাপমাত্রা থেকে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল৷ জলবায়ুর এই পরিবর্তনের চরম অবস্থা কোনও একটি দেশ বা মহাদেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই৷ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ১ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষের মৃতু্য হতে পারে৷
দেশজুড়ে এখন তাপদাহ৷ কোথাও একটু কম, কোথাও একটু বেশি৷ জলবায়ু পরিবর্তনে এই তাপপ্রবাহে সবাই অতিষ্ঠ, বলা যায় বিপর্যস্ত৷ প্রকৃতির এই উত্তাপের সঙ্গে এখন আবার ভোটের তাপ৷ কয়েকটি জায়গায় ভোট পর্ব শেষ হলেও, গোটা মে মাস জুড়ে চলবে ভোট৷ বড়, মাঝারি, ছোট নেতানেত্রীদের ছোটাছুটির শেষ নেই৷ মাঠে ময়দানে এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষ অভিযোগ আনছেন, নিজেরা কত কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন৷ আমরা আমজনতা ভিড় করছি, শুনছি গরম গরম ভাষণ৷ ভাষণের ডেসিবেলের শব্দদূষণ বাড়লে প্রকৃতির উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় কিনা তা হয়ত গবেষণার বিষয় হতে পারে৷ তবে এখানে সেখানে যেসব নির্বাচনী প্রচার হয়েছে বা হচ্ছে সেসব প্রচারে কোনও নেতানেত্রীর মুখে জলবায়ুর পরিবর্তনে আগামীদিন কী ভয়ঙ্কর হতে পারে সে সম্পর্কে একটি বাক্যও শুনেছেন বলে কেউ কি মনে করতে পারছেন৷ অথচ, তাপে পুড়ে আমি, আপনি ভাষণের তুবড়ি উপভোগ (?) করছি৷ নেতানেত্রীরা বলতেই পারেন যে জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ নিয়ে আমরা ভাবি না কে বললে! আমাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে চোখ বুলিয়ে দেখুন জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ নিয়ে আমরা কতটা উদ্বিগ্ন৷
নির্বাচনী ইস্তাহারের পাতায় আমরা চলে যাই৷ প্রথমে সর্বভারতীয় দুই দল— বিজেপি আর কংগ্রেস৷ তবে সব দলের ইস্তাহারেই পরিবেশ নিয়ে প্রতিশ্রুতি রয়েছে৷
বিজেপির ‘সংকল্প পত্রে’ (নির্বাচনী ইস্তাহার) পরিবেশ সম্পর্কে মোদিজির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে একেবারে শেষ অধ্যায়ে৷ অন্যান্য অধ্যায়ে দু’চার কথা আছে অন্য প্রসঙ্গে/বিষয়ে৷ ক্লিন এনার্জি প্রযুক্তির উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ বায়ু, সৌর, গ্রিন হাইড্রোজেন প্রযুক্তির জন্য গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ার আশ্বাস রয়েছে এই সংকল্প পত্রে৷ পরিমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রের সম্প্রসারণের কথা বলা হলেও তার লক্ষ্যমাত্রার উল্লেখ নেই এই ইস্তাহারে৷ এছাড়া আরও বলা হয়েছে যে ২০২৭ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন (Net-Zero Emission) অর্জন, অজীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি, ৬০টি শহরে জাতীয় বায়ু মানের অর্জন, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি৷
এবারের কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে পরিবেশ, জলবায়ু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিস্রুত জল ইত্যাদি সম্পর্কে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র তিন পাতা৷ পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলি গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে৷
তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য অধ্যায়ে জলবায়ু সংরক্ষণ নিশ্চিত করা, স্থায়িত্ব বাড়ানো এবং বৃহত্তর জীববৈচিত্র্যকে সহজতর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ রয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জলাভূমি পুনর্বাসন (২০৩২ সালের মধ্যে), বনভূমির অংশ বাড়ানো (১৯ শতাংশ), সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার ইত্যাদির কথাও আছে৷ জাতীয় পর্যায়ে বন সংরক্ষণ, ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম শক্তিশালী করার অঙ্গীকার রয়েছে এই ইস্তাহারে৷
সিপিএমের নির্বাচনী ইস্তাহারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য জনকেন্দ্রিক মডেলের (NAP) প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এই ইস্তাহারে মানুষ এবং তাদের জীবিকা রক্ষার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন সম্পর্কে চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে৷
যাঁরা পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন তাঁরা কিন্ত্ত রাজনৈতিক দলগুলির পরিবেশ সুরক্ষায় আন্তরিকতা নিয়েই সন্দিহান৷ নির্বাচনী ইস্তাহারে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে যত কথা বলা হয়েছে তা নৈবেদ্য সাজানোর মতো— চালের ওপর কলা৷ বলতে হয়, লিখতে হয় তাই৷ বাস্তবায়ন কয়েকযোজন দূরে৷ আর তা না হলে গত বছরের বিশ্ব পরিবেশ কার্যসম্পাদন সূচকে (Environment Performance Index) আমাদের একেবারে তলানিতে (১৮০তম) ঠাঁই হয় কী করে? এখনও সময় আছে— প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের আন্তরিকতার৷